খাওয়া নিয়ে আমি বরাবরই হুঁশিয়ার। খাবার দেখলে আর হুঁস থাকে না। বারবার বলতে হয় না। বড় হয়েছি হোস্টেলে থেকে। সেখানে আবার খাবারটা দিত বেশ ভালোই। কিন্তু বাকি সব ভুলে যেতাম শনিবার রাতে। পাতে কী পড়বে জেনে গোটা দিন মনটা শানিয়ে রাখতাম। গোটা সপ্তাহ গুটিয়ে যাওয়ার পর ‘পাখির চোখ’-টা দৃশ্যমান হত। বলা যায় পাখিটাই দৃশ্যমান হত। কাটা মাংসে বাটা মশলা ঢেলে ঢালাও চিকেন রান্না হত আমাদের বিশাল কিচেনে। ডুবে থাকা মাংসখণ্ডের উপরে একটা যত ঝাল, তত লাল – বেশ ঝালচে ঝোল থাকত। লালাক্ষরণ তাতেই অবশ্য বেশী হত। তবে সেই যুগে ‘ফ্যাটি লিভার’-এর মত ভারী কথার অভাব ছিল আর ওই বয়সে অত মেনে চলারও স্বভাব ছিল না।
যাই হোক, যে দাদারা পরিবেশন করতেন তাঁরা বেশ পরিপাটি ভাবে গামলা করে মাংস এনে টেবিলে রাখতেন। তারপর বিলিয়ে দিতেন। আমরা হামলা করতাম না। শুধু দেখতাম। সবার পাতে বরাদ্দ চার টুকরো। স্পেশাল বায়নায় কখনো ঠ্যাঙটা, বুকটা দিতেন। কেউ কেউ আবার গলা বা মেটে চাইত। আমার অবশ্য জোর নজর থাকত কচকচির দিকে। পরিবেশনকারী দাদাকে শুধু বলতাম, “অমুকদা, কচকচি দাও না!” দাদাও বিশেষ কচকচানিতে না গিয়ে দিয়ে দিতেন এক টুকরো ‘গিজার্ড’। তবে ঝোল-গঙ্গায় সেটা খুঁজে না পেলে বা একেবারেই না থাকলে তো করার কিছু নেই। কচকচির দুঃখে মনটা খচখচ-ই করত।
বিজ্ঞানভাষী পাঠক/পাঠিকা, যিনি আমার এই বিস্তৃত স্মৃতিচারণার ভাষণে ভীষণ চটেছেন, খুবই ক্ষুব্ধ, বিজ্ঞানের কণাটুকু পেলেন না এ পর্যন্ত, তাঁদের কাছে এতবড় গৌরচন্দ্রিকা করার জন্য ক্ষমা চেয়ে এবার তাহলে বিজ্ঞানেই ভাসি।
মুরগির কচকচি যে কী, তা নিয়ে হয়ত ক্বচিৎ ভেবেছি। সত্যি বলতে কী, অভিজ্ঞ মুরগিখোর হওয়ার দরুণ মুরগির অ্যানাটমিটা মোটামুটি বুঝি। কিন্তু যত গেরো ওই কচকচিতে। পরে এ নিয়ে পড়ে যা জানতে পারলাম! উফ!
আচ্ছা, এটা বলুন দেখি। মুরগির তো দাঁত নেই। তা সত্ত্বেও ওই শক্ত শক্ত দানা খেয়ে হজম করে কী করে? কোন পৈটিক বেদনা হয় না ওই খানা খেয়ে। এবার ভাবুন তো, একজন ফোকলা মানুষের পেটে যদি এক সেট দাঁত থাকত! কী ভাল হত না? চর্ব্য-চোষ্য দিব্য সাঁটানো যেত বিনা দুশ্চিন্তায়।
এই মুরগির পেটেও এক পাটি দাঁতই আছে বলা যায়। সেটাই হল ওই কচকচি। রাস্তায় দেখেছেন নিশ্চয়ই, মুরগি কেমন ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিক তাকায় আর খুঁটে খুঁটে খায়। কিছু হয়ত সত্যিই খায়। আর বাকিটা কি করে জানেন?
কোঁকর-কোঁ করতে করতেই কাঁকরজাতীয় বস্তু গিলে নেয়। না, না, খাবার হিসেবে না। ওই নুড়ি-পাথরগুলো কচকচিতে গিয়ে জমা হয়। মুরগি যা খায়, তা প্রথমে পাকস্থলীতে যায়। সেখান থেকে সেটা চলে যায় গিজার্ডে। এই গিজার্ড আসলে এক পেশীবহুল অঙ্গ। পাকস্থলীতে গিজগিজ করতে থাকা খাদ্যবস্তু স্তুপীকৃত হয় গিজার্ডে। কোঁচড়ে থাকা নুড়িসুদ্ধ কচকচির পেশীগুলো কুঁচকে গিয়ে দোমড়াতে মোচড়াতে থাকে। অনেকটা ওই ওয়াশিং মেশিনে কাপড়গুলো যেভাবে পরতে পরতে পাক খায়। সেই ঘুরপাকে গিজার্ডের পেশী জমা হওয়া নুড়ি-পাথরগুলোর সাহায্যে খাবারটাকে বেশ জমিয়ে পেষাই করে। অবশেষে খাদ্যকণা আবার পাকস্থলীতে ফিরে এসে থিতু হয় এবং তারপর তো বাকি formality আছেই।
তবে গিজার্ড শুধু মুরগিতেই সীমাবদ্ধ নয়, lizard-এও আছে। এমনকি অন্যান্য পাখি, কুমির, কেঁচো, পোকা, শামুক ইত্যাদিতেও থাকে। কোনো ক্ষেত্রে খাবারটা সটান গিজার্ড হয়েই পাকস্থলীতে যায়। আবার কেঁচোয় যেমন নো পাকস্থলী, ওনলি কচকচি। তবে ওই থরে থরে পাথর গেলার ব্যাপারটা শুধু পাখিতেই পাবেন।
যাই হোক। আজ আসি। আমার আবার ওদিকে মাংস পুড়ে গেল হয়ত!
বাই দ্য ওয়ে, ডাইনোসরেরও কিন্তু গিজার্ড ছিল। এবার আপনি বসে ভাবুন তার পরিসর কী হতে পারে!
ছবি সৌজন্যঃ অল চিকেন রেসিপিজ