কফি বানানোর বিজ্ঞান

কফি বানানোর বিজ্ঞান

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

সারা বিশ্বে প্রতি বছর দশ বিলিয়ন কিলোগ্রাম কফি ব্যবহার হয়। কফি উৎপাদনের জন্য চাই বিশেষ জলবায়ু এবং নির্দিষ্ট স্থান। কিন্ত আবহাওয়া এবং মাটির গুণগত মানকে প্রভাবিত করছে জলবায়ু পরিবর্তন, যা কফির ভবিষ্যত নিয়ে সমস্যা তৈরি করছে। উৎপাদন না বাড়িয়ে কীভাবে ভালো স্বাদের কফি তৈরি করা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে কফি ঢালার পদ্ধতি পরিবর্তন করেই এর গুণমান বাড়ানো যায়। এমনকি অপচয়ও কমে। তারা উপর থেকে ঢালা কফির বৈশিষ্ট নিয়ে কাজ করেছেন। গবেষকরা কফি রসায়নের বদলে জল কিভাবে গুঁড়ো কফির সাথে মেশে সে বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন। কম বীজ দিয়ে বেশি স্বাদগন্ধ বের করার উপায় খুঁজছেন। প্রধান গবেষক আর্নেস্ট পার্ক বলেছেন, “কফি ঢালার সময়, বেশি উঁচু থেকে জল ঢাললে জলের প্রবাহ কফি গুঁড়োতে আঘাত করার সময় লেমিনার প্রবাহ বজায় থাকে”। এটিকে ছোট বিষয় মনে হলেও গবেষণায় এর গুরুত্ব স্পষ্ট হয়েছে। জলের প্রবাহের উচ্চতা এবং আকারের সঠিক সামঞ্জস্য, কফি তৈরির প্রক্রিয়া ও স্বাদগন্ধ উন্নত করতে পারে বলে তাদের ধারণা। উঁচু থেকে স্থির প্রবাহে ঢালা জল, কফি গুঁড়োর সাথে আরও ভালোভাবে মেশে, কফিদানাগুলিকে নাড়াচাড়া করে আরও ভালোভাবে। গবেষকরা দেখেছেন যে হাঁসের গলার আকৃতির গুজনেক কেটলি, যা কফি প্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয়, জলের আদর্শ প্রবাহ তৈরি করতে পারে। এই কেটলিগুলি একটি ঘন, কেন্দ্রীভূত প্রবাহ তৈরি করে যা ছিটিয়ে পড়া বা ফোঁটায় ফোঁটায় ভেঙে যাওয়া ঠেকায়। যখন এই শক্তিশালী প্রবাহ এসে কফিদানার স্তরকে আঘাত করে, তখন এটি গতির এক নিয়ন্ত্রিত প্রবাহ তৈরি করে। দানাগুলি তরঙ্গের মতো ওঠানামা করে, তাতে আরও ভালো মিশ্রণের সুযোগ তৈরি হয়। এই গতিবিধি জল এবং কফির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া উন্নত করে। জল যত গভীরে প্রবেশ করে এবং কফিদানা নাড়াচাড়া করে, ততই তার নিজস্ব স্বাদগন্ধ বাড়ে। ফলে কম কফিদানা ব্যবহার করে কড়া কফি তৈরি করা যায়, যার স্বাদ এবং স্থায়িত্ব বেশি। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-গবেষক মার্গট ইয়ং বলেছেন, “এইভাবে উঁচু থেকে ঢেলে আপনি এই ছিটিয়ে পড়া বা ফোঁটায় ফোঁটায় ভেঙে যাওয়াটাই এড়াতে চান, কারণ এটা হলে জলস্রোত কফি গুঁড়োকে ভালোভাবে মিশ্রিত করতে পারে না।” পাতলা এবং কম তীক্ষ্ণ তরল, কফি দানার উপর পৌঁছানোর আগেই তাদের আকার হারায়। এই দুর্বল প্রবাহ, দানাগুলিকে সঠিকভাবে নাড়াচাড়া করার উপযুক্ত শক্তি দেয় না। গতিবিধি বিনা, স্বাদগন্ধর অনেকাংশই অব্যবহৃত স্তরে আটকে পড়ে। কফি গবেষণায় একটি সমস্যা হল এটি স্বাভাবিকভাবেই ঘন রঙের। তাই তৈরির সময়, জল কিভাবে কফিদানার মধ্য দিয়ে চলে, তা দেখা কঠিন। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দলটি একটি সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করেছেনu। বিশেষজ্ঞরা আসল কফির পরিবর্তে স্বচ্ছ কণা ব্যবহার করেছেন এবং সেগুলি একটি স্বচ্ছ কাচের ফানেলে রেখেছেন। তারপর, জলের গতি অনুসরণ করতে লেজার দিয়ে আধারটিকে আলোকিত করেছেন। এর ফলে বিভিন্ন প্রবাহ, কীভাবে মিশ্রণকে প্রভাবিত করে তা সরাসরি দেখা সহজ হয়েছে। তারা দেখেছেন কীভাবে লেমিনার প্রবাহগুলি দানার মধ্যে প্রবেশ করে, কীভাবে কণাগুলিকে চালিত করে এবং ঘূর্ণির মতো পথ তৈরি করে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে শক্তিশালী, স্থির স্রোত থেকে ভালো মিশ্রণ এবং সম্পূর্ণতর নিষ্কাশন হয়। গবেষকরা মনে করেন, এই কাজটি আরও ব্যাপক বিজ্ঞানের জন্য নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এখনও অনেক উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করা বাকি। যেমন দানার আকার, তাপমাত্রা, ঢালার কৌশল – যা চূড়ান্ত স্বাদের এক কাপ কফি উপহার দেয়। এগুলি শুধু রান্নার প্রশ্ন নয়, বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও বটে। এই প্রসঙ্গে গবেষণাপত্রর সহ-লেখক আর্নল্ড ম্যাথিজসেন বলেছেন, “আমরা রান্নাঘর দেখে রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞান উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যিই অনেক কিছু শিখতে পারি।” গবেষকদের পরামর্শ, এভাবে বাড়িতে চেষ্টা করুন। ঘন, স্থির প্রবাহ ব্যবহার করে, উঁচু থেকে আপনার কফি ঢালুন। দেখবেন আপনি আরও কড়া, মসৃণ স্বাদের কফি পেতে পারেন ! কখনও কখনও, সকালের এক কাপ কফির মতো অনেককিছুতেই পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 5 =