কলেরা প্রতিরোধে কাদরী

কলেরা প্রতিরোধে কাদরী

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ মার্চ, ২০২৫

ফিরদৌসি কাদরী “কলেরার রানী” নামেও পরিচিত। কলেরার উপর তার গবেষণা ও কাজ, তাকে কিংবদন্তী প্রশংসা এনে দেয়। বাংলাদেশে এই প্রাচীন রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন কাদরী । চল্লিশ বছর আগে, গোটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলমগ্রেন, ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন তৈরি করেন। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও তার ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে। ফলত প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যের উপর। সাশ্রয়ী মূল্যের ওরাল (মৌখিক) কলেরা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং তাদের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে কাদরী চালান গবেষণা। কেবলমাত্র বিশুদ্ধ জল এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা (যা ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারকে সক্ষম করে) –এর প্রচার ও উন্নয়নকে হাতিয়ার করতে থাকেন।
কাদরীর জন্ম, ঢাকায় (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান)। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নয় বরং আধুনিক অণুজীব বিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি, তার মধ্যে দেশপ্রেমের সঞ্চার করে। ১৯৭৭ সালে, কাদরী এবং তার স্বামী লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন ও ইমিউনোলজিতে ডক্টরেট করতে যান। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৬ সালে তিনি যোগদান করেন দেশের প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদর গবেষণা কেন্দ্র – আইসিডিডিআর,বিতে। সেখানে তিনি অন্ত্রের বিভিন্ন রোগজীবাণু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।তবে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল কলেরার উপর। দক্ষতা ও একাগ্রতার সাথে নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। স্বীকৃতি ও সম্মাননা মেলে দ্রুত। কাদরী গবেষণাগারের বাইরে গিয়ে প্রায়ই স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বোঝেন, একটি গরিব ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কলেরা দূর করা একটি কঠিন কাজ। এলাকায় কলেরার জন্য দায়ী জীবাণু বৃদ্ধির কারণ বোঝা কঠিন নয়। তবে অধিকাংশ বাড়িতে ক্লোরিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত জল থাকলেও ,সরবরাহ অসম। মাঝে মাঝে জলচাপ কমে গেলে দূষিত জল পাইপে ঢুকে যায়। একাধিক পরিবার একটি রান্নাঘর এবং একটিমাত্র দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেট ব্যবহার করে, যার ফলে কলেরায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই অন্যদের সংক্রমিত করে দেয়। কলেরার প্রতিরোধের সেরা উপায় হতে পারে পরিষ্কার পানীয় জল, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রদান—কলেরার পরিভাষায় যাকে বলা হয় ওয়াশ বা WASH। অথচ বাংলাদেশ এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলিতে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করার অগ্রগতি এখনও মন্থর। ফলস্বরূপ, বিশ্বজুড়ে এবং বাংলাদেশে কলেরার উল্লেখযোগ্য হ্রাসের বিভিন্ন উদ্যোগ পিছিয়ে পড়েছে । গঙ্গা নদীর বদ্বীপের লবণাক্ত জল থেকে উদ্ভূত ব্যাকটেরিয়া গত দুই শতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সাতটি কলেরা মহামারীর মধ্যে ছয়টির উৎস। যা কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে, এমনকি উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে মৌখিক টিকার মাধ্যমে কলেরাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছেন। ১৯৬০-এর দশকে বড় পরিসরের পরীক্ষায় দেখা যায় যে এই টিকার সুরক্ষা মাত্র ৫০% ছিল ও এটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কার্যকর ছিল। ফলে ১৯৭০ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এগুলো সুপারিশ করা বন্ধ করে। “ডুকোরাল” নামে এই টিকা ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এটি জন-টিকাদান প্রচেষ্টায় ব্যবহার করার পক্ষে কঠিন ও ব্যয়বহুল ছিল। প্রায় দশ বছর আগে, কাদরীর সমর্থনে বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কলেরা টিকা দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথের, কলেরা গবেষক ডেভিড স্যাক মন্তব্য করেছেন, ” মৌখিক কলেরা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে, কাদরী দীর্ঘদিনের নেতা”।
কাদরীর গবেষণা শুধু কলেরা বা টাইফয়েডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ৭৩ বছর বয়সে, তিনি সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করেন। উপেক্ষিত স্বাস্থ্য প্রয়োজন মেটাতে ও তরুণ বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ দিতে ২০১৪ সালে “ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস” প্রতিষ্ঠা করেন। কাদরী, শুধুমাত্র কলেরা নয়, সারভিকাল ক্যানসার এবং সারা শরীরে ফুসকুরি গজিয়ে ওঠা এইচপিভি রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একটি গেটস-সমর্থিত প্রকল্প পরিচালনা করছেন। তিনি থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধেও একটি প্রকল্প পরিচালনা করছেন, যার মুলে আছে প্রচ্ছন্ন বা রিসেসিভ জিন সম্পর্কিত। তাছাড়া সম্প্রতি তিনি ই-কোলাইয়ের বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিচ্ছেন। আশা করা হচ্ছে এই ভ্যাকসিন ই-কোলাইয়ের কারণে হওয়া ডায়রিয়া প্রতিরোধে কার্যকর হবে। ২০২১ সালে ড. কাদরী র হাতে র‍্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয়। তিনি ১২তম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কারটি পেলেন। বিজ্ঞানে আত্মনিবেদন , আন্তরিক প্রচেষ্টা ও লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচাতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এই পুরস্কারটি পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + 20 =