কাকাতুয়ার নৃত্যরঙ্গ

কাকাতুয়ার নৃত্যরঙ্গ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ আগষ্ট, ২০২৫

পোষ্য কাকাতুয়া শুধু মানুষের কথাই নকল করে না, তারা তালে তালে নাচেও। অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী আচরণবিদ নাতাশা লুবকে-র নেতৃত্বে নতুন এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, কাকাতুয়ার নাচের ভঙ্গি মানুষের সৃজনশীলতাকেও টেক্কা দেয়। গবেষক দল ইউটিউবের ৪৫টি ভিডিও এবং ওয়াগা ওয়াগা চিড়িয়াখানা ও অ্যাভিয়ারির সরাসরি পর্যবেক্ষণ তথ্য জড়ো করেন। ২১টি কাকাতুয়া প্রজাতির মধ্যে ১০টির ক্ষেত্রে নাচের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি! যার ১৭টি বিজ্ঞানে আগে কখনও নথিভুক্ত হয়নি। ‘নিম্নমুখী ভঙ্গি ‘-সুরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মাথা বা শরীর নীচের দিকে ঝোঁকানো বা নামানো। ‘পাশাপাশি পা ফেলা’ – তাল মিলিয়ে এক বা দুই পা পাশের দিকে সরানো। এই দুই ভঙ্গি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এরপর আসে এক পা তোলা ও মাথা গোল করে ঘোরানোর ভঙ্গিমাগুলি। এগুলি বেশ পরিচিত। কম দেখা ভঙ্গিগুলোর মধ্যে ছিল ‘লাফিয়ে ঘোরা ‘ – হঠাৎ লাফ দিয়ে আংশিক বা পূর্ণ বৃত্তে ঘুরে দাঁড়ানো। ও ‘দেহ পাকানো’ – ডানা, ঘাড় ও শরীর মসৃণ ঢেউয়ের মতো একটানা ঘোরানো বা মোচড়ানো,যেন শরীর বেয়ে সঙ্গীতের ছন্দ বইছে। কিছু পাখি আবার একাধিক পদক্ষেপ মিলিয়ে সাজিয়েছিল কোরিওগ্রাফির মতো ক্রম। ঠিক মানুষেরই মতন।
গবেষকদের মতে, এই নাচ এলোমেলো নড়াচড়া নয়, বরং শব্দ ও গতির স্নায়বিক সংযোগের ফল। একে বলা হয় এনট্রেইনমেন্ট। এতে পাখির শরীরের মুদ্রাগুলি – যেমন মাথা ঝাঁকানো, পা ফেলা, শরীর বাঁকানো – সঙ্গীতের ছন্দের সাথে একেবারে মিলে যায়। কিছু টিয়া প্রজাতির মধ্যে এটি লক্ষ্য করা যায়। বুনো কাকাতুয়া প্রেমালাপে ছন্দ ব্যবহার করে। পোষা পাখিদের নাচও অনেক সময় সেই প্রণয় আচরণের অনুরণন তৈরি করে। তবে মানুষের অনুপস্থিতিতেও নাচ দেখা যাওয়ায় গবেষকরা বলছেন,এর পেছনে আনন্দ বা স্বতঃস্ফূর্ত খেলার প্রবণতাও থাকতে পারে। লুবকে বলেন, “নাচ হয়তো কাকাতুয়ার সুখী মানসিক অবস্থার প্রতিফলন।” প্রাণী কল্যাণ গবেষণায় ‘খেলা’ বলতে বোঝায় স্বেচ্ছায়, আনন্দের জন্য, বারবার করা কাজ, যার সাথে কোনো সরাসরি পুরস্কার যুক্ত নেই। কাকাতুয়ার নাচ সেই সংজ্ঞার্থে পুরোপুরি মেলে। কিছু নাচের ভঙ্গি কেবল একটি পাখির মধ্যেই দেখা গেছে, যা নিজস্ব সৃজনশীলতার ইঙ্গিত।
গবেষণায় ছয়টি কাকাতুয়াকে সংগীত, পডকাস্ট ও নীরবতায় রাখা হয়। চমকপ্রদভাবে দেখা যায়, সব পরিস্থিতিতেই তারা নাচছে! তিন ধরণের পরিবেশে নাচের হার আলাদা হয়নি। সম্ভবত পাখিদের সংগীত শোনার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা হয়নি, অথবা হয়তো তারা সঙ্গীর প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল। নাচের ধরন ও জিনগত ঘনিষ্ঠতার মধ্যে স্পষ্ট কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। যেমন গফিন ককাটু ও হোয়াইট ককাটুর নাচে মিল থাকলেও তারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জিনের চেয়েও, কৃষ্টি ও পরিবেশের ভূমিকা নাচের ধরন গঠনে বড় । খাঁচা বা দাঁড়ে বন্দী পাখিরা অনেক সময় চাপের কারণে পালক ছেঁড়ে বা একই ভঙ্গিতে হাঁটে। তবে এটি চাপ-জনিত পুনরাবৃত্তি নয়, বরং খাঁটি আনন্দের আত্মপ্রকাশ। লুবকে মনে করেন, বন্দী কাকাতুয়ার জীবনে সংগীত যোগ করলে তা মানসিক চাপ কমাতে এবং আনন্দ বাড়াতে সাহায্য করবে। তবে যেকোনো সংগীত নয়, তাল, গতি ও ধরণের ভূমিকা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় যা উঠে আসছে, তাতে ককাটুর নৃত্যমঞ্চ কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং প্রাণীর আবেগ, সৃজনশীলতা ও মস্তিষ্কের ক্ষমতা বোঝার জন্যও এক আশ্চর্য মঞ্চ। তারা নাচে একা কিংবা সঙ্গীর সাথে। সংগীতে বা নীরবতায়, একই ভঙ্গিতে বারবার নাচে, আবার নতুন ভঙ্গি আবিষ্কার করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, “পাখির নাচ দেখতে মজা লাগলেও, প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে আচরণ, কৃষ্টি আর স্নায়ুবিজ্ঞানের কাহিনী।”

সূত্র : Dance behaviour in cockatoos: Implications for cognitive processes and welfare by Natasha Lubke, et.al ; Plos One(August 06 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four + nine =