কাল-কেলাসের কাণ্ড

কাল-কেলাসের কাণ্ড

শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted on ১০ এপ্রিল, ২০১৯

সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র না-হোক, মানুষ হাঁ ক’রে দেখতে ভালোবাসে বটে! সৌন্দর্যের মধ্যে একরকম সমতা যে আছে, এ-কথা গাণিতিকভাবে যেমন সত্য, তেমনই মানুষ সেই সমতায় আকৃষ্ট হয় এটাও সত্য। কেন মানুষে এমন পছন্দ করে, সে এককথায় ব’লে বোঝানো ভারী মুশকিল, কিন্তু আমায় যদি বলো রাস্তার ঢেলা আর হীরের মধ্যে একটা বেছে নিতে তো আমি হীরেটাই নেবো। জ্যান্ত প্রজাপতি আর মাকড়সায় আধখাওয়া প্রজাপতির মধ্যে বেছে নেবো প্রথমটাকেই। ভাঙা আয়না নয়, গোটা চারচৌকো বা গোল আয়নাই দাম দিয়ে কিনবো। তাজমহল ফেলে নিশ্চয় যমুনার পচা পাড়ে তাকাতে ইচ্ছে করে না! স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ না শেয়ালদা স্টেশনের ভিড়, কোনটা দেখতে পছন্দ করবেন? সবকিছুর মধ্যে প্যাটার্ন আর তার সমতা খুঁজে পেলে চোখ যেন শান্তি পায়, মন যেন মুগ্ধ হয় আমাদের! পাউডার করা জিনিস দেখতে যত না ইন্টারেস্ট, তার থেকে ঢের বেশী ইন্টারেস্ট তাই স্ফটিকের মত চকচকে জিনিস দেখতে। দেখতে এমন ভালো লাগার কারণটা ঠিক কী হতে পারে?

চারপাশের জিনিস, অথবা তার গুঁড়ো, আকারে এবড়োখেবড়ো যেমন হতে পারে তেমনই হতে পারে ঠিকঠাক মাপ ক’রে কাটা আকারের। প্রথমগুলো পাউডারের মতো গুঁড়ো অবস্থায় পাওয়া যায়, নিয়ম মেনে চলা জ্যামিতির কোনো ঘনবস্তু নয় সেই গুঁড়োগুলো। তাই তা এককথায়, অনিয়তাকার। দ্বিতীয় জিনিসগুলো ঠিক এর উল্টো! তাদের নির্দিষ্ট আকার আছে। যেন কোনো জ্যামিতির ঘনবস্তু, আয়তঘন, ঘনক, রম্বস, অথবা ষড়ভুজাকার এমন আরো কতও রকমের। এরকম জিনিসকে বলে নিয়তাকার, অর্থাৎ যার কিনা নিয়ত বা নির্দিষ্ট আকার আছে। ওদের উপর আলো পড়লে ছিটকে আসে আর চকচকে দেখায়। রসায়নবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্ফটিকাকার বা কেলাসাকার পদার্থ। খাবার নুন এরকম কেলাস দিয়ে তৈরী। খালি চোখে দেখলে মনে হবে গুঁড়ো গুঁড়ো পাউডারের মতো, কিন্তু মাইক্রোস্কোপে লুডোর ছক্কার মতো দেখতে কেলাসের দানাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাবে।

সোডিয়াম ধাতু থেকে পাওয়া পজিটিভ সোডিয়াম আয়ন আর ক্লোরিন গ্যাস থেকে জন্ম নেওয়া নেগেটিভ ক্লোরিন আয়ন, এই দুইয়ের মিলে খাবার নুন তৈরী হয়। একেকটা নুনের কেলাসে এরকম অনেক আয়ন থাকে, কিন্তু তারা কেউ শেয়ালদা স্টেশনের ভিড়ের মতো কিংবা হাওড়া স্টেশনের টিকিটের লাইনের মতো গুঁতোগুঁতি করে না! তাহলে তারা কীভাবে থাকে?

একটা সোডিয়াম আয়নকে ঘিরে উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে আর উপরে নীচে ঠিক সোজাসুজি ক’রে ছয়খানা ক্লোরিন আয়ন সমান দূরে ব’সে থাকে। ব্যাপারটা শুধু এইখানে শেষ হলে পণ্ডিতেরা নিশ্চিন্ত হতেন! কিন্তু দেখা গেছে, ওইরকম যে ছয়টা ক্লোরিন আয়ন, তার প্রতিটাকে মাঝে রেখে, আবার সেই ছয়দিক থেকে ছয়খানা সোডিয়াম আয়ন তাকে ঘিরে রেখেছে। যেন দুটো আয়নই ছয়দিক থেকে ঘিরে একে অন্যকে পাহারা দিচ্ছে, একটুও বেচালে কেউ গুঁতোগুঁতি করতে পারছে না! পুরো ব্যবস্থাটাকে একনজরে দেখলে মনে হবে, দুইরকম আয়নে কেলাসের ইস্কুলে প্রার্থনা সভায় দাঁড়িয়ে আছে একটা সুন্দর প্যাটার্নে। একটা দুটো নয়, এরকম অনেক আয়ন একে অপরকে ঘিরে ধ’রে সুন্দর নির্দিষ্ট প্যাটার্নে ছড়িয়ে আছে। শুধু উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে হলে আয়নগুলো দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে ছড়িয়ে থাকতো, কিন্তু উপরে নীচেও আয়নদের ঘিরে ব’সে থাকার প্যাটার্নটা বজায় থাকছে ব’লে দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর উচ্চতা মিলে একটা নির্দিষ্ট আকারের ত্রিমাত্রিক কেলাস তৈরী হচ্ছে।

শুধু নুনের কেলাস নয়, কেলাস মানেই এরকম নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সাজানো পরমাণু বা আয়নের পিণ্ড। যেমন প্রজাপতির পাখা, যেমন তাজমহল, যেমন সেনাদের কুচকাওয়াজ, সবকিছুতে একই রকম জিনিস কিংবা নকশা কিংবা স্টাইল, একরকম জায়গায় বারেবারে ফিরে আসে ব’লে দেখতে এতো ভালো লাগে, তেমনি কেলাসে একই রকম পরমাণু বা আয়নেরা নির্দিষ্ট দূরত্বে বারেবারে ফিরে আসে। প্রকৃতির কী অদ্ভূত নিয়ম! কেলাসেরা নিশ্চয় বাংলার ‘কেলাস’গুলোতে ‘শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা’ রচনাটা শুধু লেখেই নি, কাজেও প্র্যাকটিস করেছে! তাই শৃঙ্খলাপরায়ণ কেলাসেরা দেখতে এতো সুন্দর।

মানুষের স্বভাব হলো, অপার সৌন্দর্যের অধিকারিণীকে শুনিয়ে শুনিয়ে ‘ও কেন এতো সুন্দরী হলো’ তা বলা! কেলাস সেই মানবিক আক্রমণ থেকে বেঁচে যে যাবে না, তা বলাই বাহুল্য। অতএব ভিতরের কণাগুলোর যে সমান সমান সুন্দর সজ্জারীতির গুণে কেলাসের এতো নামডাক, পণ্ডিতেরা সেই রীতিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছু গলদ বার ক’রে ফেলেছেন। ঠিক কোন জায়গায় এতো সুন্দর সজ্জারীতির গলতি ধরা পড়লো?

আমরা সাধারণ মানুষে এই মনে করি যে, কোনো জায়গা জুড়ে জিনিসপত্রকে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা সজ্জারীতিতে সাজানো হলে জায়গাটার চেহারা বেশ সমান সমান মাপে খোলতাই হবে, এলোমেলো হয়ে থাকলে বেশী জায়গা নষ্ট হয় যে! যেমন এই আপনার ডেস্কের কথাই ধরুন না! এলোমেলো ক’রে বইখাতা রাখলে আপনি লেখাপড়া করার জায়গা পেতেন না, তাই বই খাতাগুলো গুছিয়ে সমান সমান ক’রে রাখলেন। বড় বইগুলো তলায় রেখে তার উপরে ছোট বইগুলো রেখে ভাবলেন, আঃ, এতক্ষণে জায়গাটা বেশ সমান ক’রে গোছানো গেল বটে!

ঠিক এইখানেই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আমাদের সাথে পণ্ডিতমশাইদের। পদার্থবিদ্যার আলুকে যাঁরা যুক্তিবিদ্যার পোস্ত আর অঙ্কের ফোড়ন দিয়ে রেঁধে খেয়েছেন, তাঁরা মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন, ‘জায়গা আর সমানে সমানে সাজানো হলো কই? জিনিসগুলোই যা সাজিয়ে ফেললেন দাদা!’ এ আবার কী হেঁয়ালি?

আসলে জিনিস যত নির্দিষ্ট রীতি মেনে সাজানো হবে, সেই সজ্জাটাকে দেখতে বিভিন্ন দিক থেকে লাগবে বিভিন্নরকম। সাজানো ডেস্কের ওপরটা পাশ থেকে দেখলে যেমন দেখতে লাগবে, উপর থেকে দেখলে নিশ্চয় সেরকম লাগবে না। ঠিক তেমনি, পাউডার যেদিক থেকেই দেখি, বিশেষ তফাত চোখে ধরা পড়বে না। অথচ, একই কেলাসকে বিভিন্ন দিক থেকে নজর করলে কখনো বেশী চকচকে লাগবে, কখনো কম চকচকে লাগবে, কখনো বা আদৌ চকচকে লাগবে না। ল্যাবরেটরিতে শুধু দেখা নয়, সেই জায়গাটার বিভিন্ন দিক থেকে কেলাসগুলোর অন্য সমস্ত ধর্ম, যেমন তাপ কিংবা ইলেকট্রিক কতটা বইতে পারে এইসব, মেপে দেখা হল। তাতে ধরা পড়ল, এক-এক দিকে কেলাসগুলোর ধর্ম এক-এক মানের, অর্থাৎ জায়গা জুড়ে ভৌতধর্মের কোনো সমতা নেই কেলাসগুলোতে! সোজা কথায়, জিনিস যত সাজানো গোছানো নিয়মমাফিক তৈরী হচ্ছে, জিনিস-থাকা জায়গাটার সমতা তত ভ্যানিশ হচ্ছে! একে ঘুরিয়ে পণ্ডিতেরা বললেন, শূন্যস্থানের প্রতিসমভাব ভেঙে দিয়েছে কেলাস বা ক্রিস্টাল। শূন্যস্থান আবার কোত্থেকে এলো?

কোনো জিনিসের প্রকৃতি যদি খুব ঝামেলা পাকায় পদার্থবিদের গণনায়, তবে জিনিসটাকে খাতায় কলমে ভ্যানিশ ক’রে তিনি প্রথমে একটা শূন্যস্থান বা পুরো ফাঁকা জায়গা কল্পনা ক’রে ভাবেন, কী হতে পারে। তারপরে, তার মধ্যে ঝামেলাপাকানো জিনিসটাকে বসিয়ে ফের কল্পনা করেন, কী হতে পারে। ফাঁকা জায়গা, অতএব, বিজ্ঞানীদের কাছে মোটেই ফাঁকিবাজি বিষয় নয়, বরং যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এরকম জায়গায় কোনো জিনিস কোথায় আছে বোঝাতে তিনটে মাত্রা লাগে – দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা। এখন, কেলাস যখন ছিল না, তখন জায়গাটার সব দিকেই সব রকম ভৌতধর্মের মানে (measured value) একটা সমতা ছিল। যেদিক দিয়েই মাপা হোক, একই মান পাওয়া যেত। কিন্তু কেলাস যেই ঢোকানো হল সেই ফাঁকা জায়গায়, ওমনি জায়গার সেই সমতা গেল নষ্ট হয়ে। নিজের ভেতরটা যেহেতু নির্দিষ্ট রীতিতে সাজানো, সেহেতু কেলাস নিশ্চিন্তে ত্রিমাত্রিক শূন্যস্থানের সমতা (symmetry) বিনাশ করেছে। কেলাসমাত্রই এভাবে স্থান বা জায়গার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতার সমতা ভেঙে দিয়ে থাকে। এবং এটাই হচ্ছে কেলাসীয় সৌন্দর্যের সেই একমাত্র ‘গলদ’! এ গলদ বা খুঁত সার্বজনীন ও স্বাভাবিক এবং প্রকৃতিতে অন্য প্রচুর উদাহরণ আছে। পরমাণু এবং পারমাণবিক কণাগুলোর একটা ধর্ম স্পিন। স্পিন বলতে যদিও আমরা ক্রিকেট বল বা লাট্টুর ঘোরার মতো কিছু বুঝি, কিন্তু আসলে আমাদের জগতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে না, যার সাথে এই সব পারমাণবিক কণাদের স্পিন ধর্মটাকে তুলনা করা যায়। শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে, কণাদের স্পিনের নির্দিষ্ট দিক থাকে, আর নির্দিষ্ট মাত্রাও থাকে। সাধারণ লোহার পেরেকে লোহার পরমাণুগুলোর স্পিন সবরকম দিকে মুখ ক’রে থাকে। তাই স্পিন ধর্মের একটা সমতা থাকে। কিন্তু যদি ওটাকে চুম্বকিত করা হয় তবে তার লোহার পরমাণুগুলোর স্পিন সব একটাই নির্দিষ্ট দিকে মুখ ক’রে ফেলে। তখন সে জায়গায় স্পিন ধর্মের সমতা ভেঙে যায়।

শুধু যদি এইখানেই ‘খুঁত’টা সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে খুঁতখুঁতে পণ্ডিতমশাইরা বেকার হয়ে বাড়ীতে ব’সে থাকতেন! বর্তমানে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের মাস্টারমশাই ভিলজেক সেরকম ব’সে থাকার পাত্র নন। জাতিতে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক ভিলজেক, ২০১২ সালে, দুনিয়ার লোকের সামনে এক অদ্ভূত আব্দার ক’রে বসেন! কেলাস যদি স্থানের সমতা ধর্ম নষ্ট করে, তবে তাত্ত্বিকভাবে কেলাস কালের সমতাও বিনাশ করতে পারে, এই ছিলো মাস্টারমশাইয়ের মূল বক্তব্য সেদিন। নোবেলজয়ী মাস্টারমশাই বলেছেন ব’লে কথা, সবাই ভাবতে বসলেন, কালের সমতা আবার কী জিনিস রে বাবা, এমন আনাড়ি কথা তো কস্মিনকালেও শুনি নি!

সাত দুগুণে যদি চোদ্দো হয়, তাহলে সে সব সময়ই চোদ্দ, এক ঘন্টা আগে হলেও যা, দশদিন পরে হলেও তাই! নিউটনের মহাকর্ষসূত্র, কুলম্বের তড়িদাধানের আকর্ষণ-বিকর্ষণ সূত্র, এগুলোও গতকাল যা ছিল, আজও তা-ই আছে, আগামীতেও তা-ই থাকবে। একে বলে কাল বা সময়ের সমতা। এর একটা গালভরা নাম আছে – ‘টাইম ট্রান্সলেশনাল সিমেট্রি’। এই প্রাথমিক ইঁটটা না-গাঁথলে প্রথাগত পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলো দিয়ে বাড়ী বানানো মুশকিল হি নেহি, না-মুমকিন হ্যায়। কিন্তু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ডন তিনিই, যিনি পদার্থবিদ্যার প্রথাগত ধারণার মূলে আঘাত করেন, যেটা করার জন্য প্রোফেসর ভিলজেক অলরেডি বিখ্যাত। আরেক গুরুদেব (পড়ুন ডন) আইনস্টাইন অনেক আগেই চিরাচরিত পদার্থবিদ্যাকে ভালো মতো চিমটি কেটে দিয়ে গেছেন এই ব’লে যে, স্থান আর কাল ব্রহ্মাণ্ডের কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই ছাড়া আর কিছুই নয়! তার ধুয়ো তুলে বিজ্ঞানী ভিলজেক বললেন, এমন কেলাস নিশ্চয় তৈরী করা সম্ভব যা স্থানের সাম্যভাবই শুধু বিনাশ করবে না, কালের সাম্যভাবও বিনাশ করবে। এর নাম হবে ‘টাইম ক্রিস্টাল’, না না, টাইম ক্রিস্টালাইজড হয়ে যাবে না, যেমন অ্যাকশন ফিল্মে দেখায়, ওরকম হবে না, টাইম কেলাসিত হয়ে থমকে যাবে না! বাংলায় একে বলা যাবে ‘কাল-কেলাস’। সে সব না হয় হলো, কিন্তু এখন এই কালের সাম্য কী ক’রে বিনষ্ট হবে? ‘কাল কিসনে দেখা হ্যায়?’

দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আর উচ্চতা যেমন আমাদের দুনিয়ার অতিপরিচিত তিনটে মাত্রা, তেমনি কাল বা সময় হলো পণ্ডিতদের মতে চার-নম্বরি মাত্রা। সময়কে মাত্রা হিসেবে কল্পনা করা মুশকিলই বটে! কারণ সময় একটা ট্রেনের মতো, যেটা কেবলি সামনের দিকেই ছুটছে ব’লে আমরা ভাবতে বাধ্য, কারণ আমরা যে সেই ট্রেনেই চ’ড়ে আছি, নেমে যে বাইরে থেকে ট্রেনটাকে দেখবো, তার জো নেই! পণ্ডিতদের মুণ্ডু কী দিয়ে তৈরী কে জানে, তাঁরা বললেন, কল্পনায় সময়কেও দৈর্ঘ্যর মতো একটা লাইন ব’লে ধরা যায়। তারপর যদি কেউ সেই লাইন বরাবর ছোটাছুটি করতে শুরু করে আপ কিংবা ডাউন ট্রেনের মতো, তাহলেই হয়ে গেল সময় নামক চতুর্থ মাত্রার জন্ম। কিন্তু সেরকম টাইম ট্রাভেল তো হয় না ব’লেই আমাদের ধারণা, তাহলে তো এইচ. জি. ওয়েলস-এর টাইম মেশিন কবে বিজ্ঞানীরা তৈরী ক’রে ফেলতেন! চতুর্থ মাত্রা সময়, আমাদের মতে, সর্বদা সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

কাল-কেলাস যখন সময়ের সিমেট্রিকে ভেঙে ফেলে, তখন সময়ের লাইন বরাবর কাল-কেলাস সামনে এগোয়, পিছনে পিছোয়! অর্থাৎ, কেলাসের সুন্দর নির্দিষ্ট খাঁচার গঠন এই যেমন ছিল, কিছুক্ষণে অন্যরকম হয়ে যায়। রুমাল থেকে বেড়াল থেকে সোয়েটার থেকে কুকুর থেকে হিজিবিজবিজ থেকে মেজদা থেকে ফের রুমাল থেকে ফের বেড়ালের রাস্তায় ফিরে আসে, আসতেই থাকে, আসতেই থাকে! আপনি ভাবলেন, এ আবার এমন কী! ছিল দেশলাইয়ের বাক্সের ঢাকনা, দুপাশে চাপ দিলাম, আকার পাল্টে গেল! হাতের মুঠোয় রেখে মুচড়ে দিলাম, আকার আবার পাল্টে গেল! কেলাসও সেরকম ক’রে আকার পাল্টাবে। এখানে আবার একটা প্যাঁচ আছে! বাইরে থেকে জোর খাটিয়ে জিনিসের আকার পাল্টাতে হলে চাই শক্তি। কাল-কেলাস এইভাবে আকারের পরিবর্তন ঘটায় না, পরিবর্তন ঘটে আপনা থেকেই, কোনো শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই। জিনিসে সবচাইতে কম যে শক্তি ধরতে পারে, পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি সেই অবস্থাতেও কাল-কেলাসের আকার পাল্টাতে থাকবে। এটা একরকমের সাংঘাতিক কল্পনা: কোনো বাইরের শক্তি বা বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে না, কেলাস যেন জ্যান্ত বস্তুর মতো তার আকার নিজে নিজেই পাল্টে ফেলছে! ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের প্রেস্টিজ মানে সমতা একেবারে পাংচার ক’রে দেওয়া এরকম কাল-কেলাস কি সত্যিই মানুষ তৈরী করতে পারবে?

একটা সাম্যাবস্থায় কোনো জিনিস যখন থাকে, তখন তার শক্তি হয় সবচাইতে কম। কিন্তু ভিলজেকের মতে, কাল-কেলাস সেই সবচাইতে কম শক্তি ধরা অবস্থাতেই প্রচলিত অর্থে সাম্যাবস্থায় থাকে না, বরং তার সাজন-গোজনের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে, যেটা সময়ে সময়ে পাল্টে যায়! ভিলজেকের এই ধারণাকে সমর্থন করলেন আরেক বিজ্ঞানী জিয়ান ঝ্যান্। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোপ্রকৌশলের মাস্টারমশাই বললেন, কাল-কেলাসের একরকম মডেলঃ সবসময় ঘুরছে এরকম একগুচ্ছ আয়ন দিয়ে তৈরী হতে পারে সেই মডেল।

যে জিনিসের যা হবার কথা তা না-হলে পি সি সরকারের ম্যাজিক হয় বটে, কিন্তু সেটা বাস্তবে হয় কিনা তা নিয়ে সপক্ষে বিপক্ষে মতবাদ থাকবেই! বিতর্ক তুঙ্গে উঠলো যখন পৃথিবী জুড়ে, বিজ্ঞানীরা কাল-কেলাস যে হতে পারে না তার সপক্ষে তাত্ত্বিক যুক্তি খাড়া করতে থাকলেন। কেউ বললেন, স্থান-কাল কেলাস অসম্ভব! কেউ বললেন, সম্ভব বটে, তবে সবচাইতে কম শক্তি ধরা অবস্থায়, অসম্ভব।

বিস্তর তর্কবিতর্ক ঠেলে পণ্ডিতেরা একসময় একমত হলেন, কাল-কেলাস সম্ভব বটে, তবে যেরকম ভাবে নোবেলজয়ী ভিলজেক বলছেন, সেরকম ভাবে নয়! স্রেফ পরমাণু বা আয়ন নিয়ে নয়, বরং তাদের স্পিন ধর্মকে সাজিয়ে গুজিয়ে কাল-কেলাস বানানো যায়। কীভাবে?

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই ক্রিস্টোফার মনরো-র নামডাক আসলে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের যত্তসব দুরূহ আর অসম্ভব এক্সপেরিমেন্টগুলো অবলীলায় ক’রে ফেলার জন্য! এবার (২০১৭) তাঁর সেই পরীক্ষার ঠ্যালায় পড়েছিল ১০ খানা ‘ইটারবিয়াম’ ব’লে একরকম মৌলের আয়ন। কোয়ান্টাম-স্যাকরা মনরো তাদের বিশেষ ব্যবস্থা ক’রে একটা শেকলের মতো সাজালেন। এখন হয়েছে কি, কোয়ান্টাম জগতে পরমাণু বা আয়নে নিজেদের ভেতর স্পিনে স্পিনে কথা বলে। এমনি অবস্থায় আয়নগুলো দিব্যি একের সাথে অন্যের স্পিন জড়িয়ে যা তা অবস্থায় ছিল। মনরো গোল বাধালেন দুরকম লেজার রশ্মি তাদের গায়ে ছুঁড়ে! লেজার রশ্মি যেন ক্লাসের রাগী পণ্ডিতমশাই, একবার ক্লাসের মুখে দেখা দিল কি সবাই চুপ ক’রে গেল, আরেকবার দেখা দিল কি কেউকেউ বই খুলে সেদিনের পড়া জোরসে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু ক’রে দিল, আর যারা বই আনে নি তারা নিশ্চিত ঠ্যাঙানি খাবার ভয়ে ঘেমে নেয়ে একসা হলো! ইটারবিয়াম আয়নের শেকলটাও সেরকম প্রথম লেজার রশ্মির তৈরী করা চৌম্বকক্ষেত্রে চুপ মেরে গেল, আর দ্বিতীয় লেজার রশ্মির জন্য কারো কারো স্পিন গেল পাল্টে। লেজার রশ্মি পড়া যেই বন্ধ হলো অম্নি আবার যে কে সেই, আয়নগুলোর স্পিন আগের মতো সজ্জায় ফিরে গেল, মানে বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর! লেজার এভাবে বারংবার অন অফ করতে থাকলে স্পিন গুলোর সজ্জা যে বারবার পাল্টে পাল্টে আবার প্রথম অবস্থায় ফিরে আসবে তা বলাই বাহুল্য! এটার সাথে কেলাসাকার অবস্থার একটা মিল আছে ব’লে মনে হল। কিন্তু এই অব্দি ঠিক থাকলে ক্রিস্টোফার মনরোর মন ভরছিল না।

মনরো আর তাঁর টিম এক মজার জিনিস লক্ষ্য করলেন, লেজার অন অফ করার মাঝে স্পিনগুলোর এই সজ্জা পরিবর্তন ঘটছিলো একবার নয়, দুইবার ক’রে। রাগী পণ্ডিতমশাই ক্লাসে উঁকি দেবার সাথে সাথে ক্লাস চুপ, আর কেউ কেউ বই খুলে পড়তে থাকে, তারপরে ফিরে গেলে আবার যে কে সেই, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি উঁকি দেওয়া আর ফিরে যাওয়ার মাঝে আপনা থেকেই এই চুপ ক’রে যাওয়া আর বই খুলে পড়া দু’দুবার ঘটে, তবে কি মাঝে মাঝে ক্লাসে পণ্ডিত ছাড়াও ভূতে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে?

অন্য বিষয়ে বলা যায় না, কিন্তু পদার্থবিদ্যায় এভাবে যতবার ভূতে নিয়ম ভেঙেছে, ততবার হইচই প’ড়ে গেছে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না, লেজার যে ছন্দে অন অফ হচ্ছে, ইটারবিয়াম আয়নগুলোর স্পিন কিন্তু সে ছন্দে পাল্টাচ্ছে না! তাদের স্পিন সাজানোর ছন্দ একদম আলাদা, যেন বাইরের কোনো শক্তি ছাড়াই সেই স্পিনসজ্জা পর্যাবৃত্ত গতিতে পরিবর্তন হয়ে চলেছে। একই সজ্জা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফিরে ফিরে আসছে। আপনার ভুঁড়িতে যদি কেউ টুসকি দিয়ে নাড়িয়ে দেয়, তারপর সেটা যদি আপনা থেকেই নড়তে থাকে, নড়তেই থাকে, টুসকি আর না দিলেও, তবে আপনার অস্বস্তি হবেই। অবশ্য এই অস্বস্তিতেই প’ড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সজ্জাটা হেভি লজ্জা পেয়ে রিপিট করা বন্ধ ক’রে দেয়! কিন্তু যতক্ষণের জন্য এই স্পিনসজ্জা আপনাথেকে রিপিট করতে থাকে অন্ততঃ ততক্ষণের জন্য, পদার্থবিদের ভাষায়, ওটা হলো পদার্থের স্পিনের সেই কাল-কেলাসীয় অবস্থা। আরো স্পষ্টভাবে বললে, এ যেন স্পিনের জেলি, নির্দিষ্ট সময় অন্তর টোকা মারতে থাকলে জেলি যেমন কাঁপে তেমনি কাঁপে বটে, কিন্তু টোকার ছন্দের সাথে সেই কাঁপনের ছন্দ মেলে না। টোকা না মারলেও নিজের ছন্দে কাল-কেলাস কাঁপতে কাঁপতে স্পিনসজ্জা নিজস্ব একটা নিয়মে পাল্টাতে থাকে। কিন্তু লেজার রশ্মির কম্পাঙ্কের একটু বেশী কম হয়ে গেলে সেই কাল-কেলাসীয় অবস্থা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।

একই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল হার্ভার্ডের মাস্টারমশাই মাইকেল লুকিন-এর পরীক্ষায়। হীরের ভিতরে থাকে একরকমের ফাঁক, যেখানে মাঝেমাঝে কার্বন পরমাণুকে ফাঁকি মেরে নাইট্রোজেনের পরমাণু জায়গা দখল করে! সেই পরিস্থিতিতে কাল-কেলাসীয় অবস্থার প্রমাণ পেলেন লুকিন আর তাঁর টিম। এই দুটো পরীক্ষার পরে সারা পৃথিবী থেকে এরকম কাল-কেলাসীয় দশার অজস্র প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগলো। তার মধ্যে আমাদের দেশের পুণের আইসার গবেষণাগারে বিজ্ঞানী গণেশ শ্রীজিত-এর টিমের নাম না-করলে ভারী অন্যায় হবে। কার্বন, হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের স্পিন ব্যবহার ক’রে তাঁরা কাল-কেলাস দশার অস্তিত্ব প্রমাণ ক’রে দিলেন এই বছরের শুরুতে।

একটি ধারণা, কল্পনা থেকে প্রবল বিরোধিতা সামলে বাস্তবের মাটিতে পদার্থের একরকম দশা হিসেবে সবে অবতীর্ণ হলো। বিজ্ঞান হয়তো এরকমই। আজকে যা কল্পনা, কালকে তা জিনিস। কাল-কেলাসের কাণ্ডকারখানা ব্যবহার ক’রে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, আর তথ্য সংরক্ষণ কীভাবে উপকৃত হয়, সেটাই এখন দেখার।

One thought on “কাল-কেলাসের কাণ্ড

  1. Shanku Goswami

    দারুণ informative আর সুখপাঠ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × five =