আমরা সবাই হয়তো কখনও না কখনও ভেবেছি, যদি পোষ্য কুকুরটি হঠাৎ করে মুখ খুলে কিছু বলে ওঠে? এই যেমন,“চলো, হাঁটতে যাই!” শিশুসাহিত্য আর সিনেমায় এমন গল্প অজস্র।কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এই প্রশ্নটি এখন একেবারে নতুনভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে – কুকুর কি সত্যিই “কথা বলা” শিখতে পারে? মানব ইতিহাসে অন্তত ৩০ হাজার বছর ধরে মানুষ ও কুকুর একসঙ্গে পথ চলেছে। এই দীর্ঘ সহাবস্থান শুধু গৃহপালন নয়, একধরনের সহ-বিবর্তনের কাহিনীও। গবেষকরা বলছেন, কুকুররা মানুষের মুখভঙ্গি, দৃষ্টি, এমনকি মনোভাবও বোঝার এক অদ্ভুত ক্ষমতা অর্জন করেছে। আবার মানুষও তাদের ঘেউ ঘেউ, লেজ নাড়া বা চাহনির অর্থ বোঝায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এই পারস্পরিক বোঝাপড়াই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের মূল বিষয়। এ এক ধরনের ‘আন্তঃপ্রজাতিক ভাষা’! যদিও সেটি আমাদের প্রচলিত ভাষার মতো নয়। মানব ভাষা একটি জটিল শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়া। এতে জড়িত থাকে ফুসফুস, কণ্ঠনালি, মুখ, ঠোঁট, জিভ ও মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চল। মানুষের কণ্ঠনালি শরীরে মুখের নীচের দিকে অবস্থিত, ফলে আমরা বহু রকম স্বরধ্বনি তৈরি করতে পারি। অন্যদিকে, কুকুরদের কণ্ঠনালি তুলনায় উঁচুতে। তাদের মুখগহ্বর ও স্বরযন্ত্র দুইই শব্দ উৎপাদনের জন্য নয়, গর্জন, হাহাকার, হাঁপানো বা ঘেউ ঘেউ প্রভৃতি সংকেত পাঠানোর জন্য উপযুক্ত। অর্থাৎ, তারা ধ্বনি তৈরি করতে পারে, কিন্তু সেই শব্দগুলোকে ভাষার মতো করে গড়তে পারে না। ফলে “আমি রেগে গেছি কিংবা আমার খিদে পেয়েছে”এই ধরণের জটিল বার্তা তারা স্বর দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। যদিও দেহভঙ্গিতে সেটা বোঝাতে তারা সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, পোষ্য কুকুররা শতাধিক শব্দ চিনতে পারে।“বসো”, “খাও”, “বল আনো” ইত্যাদি নির্দেশে তারা চমৎকার সাড়া দেয়। তবে তারা মানুষের মতো করে নতুন বাক্য গঠন বা শব্দের যৌক্তিক সম্পর্ক বুঝতে পারে না। ব্রেইন ইমেজিং বা মস্তিষ্কের স্ক্যান থেকে দেখা যায়, পরিচিত শব্দ শুনলে কুকুরদের মস্তিষ্কের কিছু অংশ সক্রিয় হয়। কিন্তু মানব ভাষার জন্য দায়ী জটিল নেটওয়ার্ক, যেমন- ব্রোকা ও ভার্নিকি অঞ্চল, তাদের মধ্যে ততটা বিকশিত নয়। তবে আমরা ভাষাকে শুধু “শব্দ” দিয়ে বিচার করি। কিন্তু যোগাযোগ কেবল শব্দের মাধ্যমে হয় না। কুকুরদের নিজস্ব এক যোগাযোগব্যবস্থা আছে। দেহের ভঙ্গি, লেজের নড়াচড়া, কান ও চোখের অঙ্গভঙ্গি, এমনকি ঘেউ ঘেউ-এর কম্পাঙ্ক দিয়েই তারা জটিল অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কুকুররা মানুষের মুখের অভিব্যক্তি দেখে তার আবেগ বোঝে। ভয়, রাগ, আনন্দ ইত্যাদি শনাক্ত করতে পারে। অর্থাৎ, তারা ইতিমধ্যেই আমাদের সঙ্গে একধরনের “ভাষাহীন কথোপকথন” চালিয়ে যাচ্ছে। মানব ভাষার উৎপত্তি কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের ফল। তাই কুকুরের ভাষিক বিবর্তন আমাদের পথে যাবে, এমন আশা বাস্তবসম্মত নয়। তবু এই প্রাণীটি আমাদের সঙ্গে যেভাবে মানিয়ে নিয়েছে, তা ভাষা-বিবর্তনের গবেষণার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান থেকেও কুকুররা শিখেছে। যোগাযোগ মানে শুধু উচ্চারণ নয়, বরং মনোযোগ, অনুভব ও প্রতিক্রিয়া। তাই বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, পোষ্যটি হয়তো কখনো “চলো, হাঁটি” বলবে না, কিন্তু এই বোঝাপড়াই ভাষার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক।
সূত্র : Let’s talk about “talking” dogs! Reviewing the science behind a bold idea; Biologia Futura; Rita Lenkei et.el; Published: 29 July 2025
