কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: মগজে কুয়াশা    

কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: মগজে কুয়াশা    

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ নভেম্বর, ২০২৫

ক্যান্সার এক বিশাল যুদ্ধ।এর চিকিৎসা যেমন মানসিক ও শারীরিকভাবে মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়া কঠিন, তেমনি চিকিৎসার পর অনেক রোগী ভোগেন এক অদ্ভুত মানসিক সমস্যায়, যার নাম “কেমো ব্রেন” বা “ব্রেন ফগ”। এতে রোগীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়, কথা বলতে গেলে শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যা হয়, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও বিভ্রান্তি দেখা দেয়। গবেষণা বলছে, কেমোথেরাপি নেওয়া প্রতি চারজন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে তিনজনই এই অবস্থার শিকার হন এবং এর রেশ অনেক সময় চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও থেকে যায় বছরের পর বছর ।

সম্প্রতি ভার্জিনিয়া টেকের বিজ্ঞানীরা এই “কেমো ব্রেন”-এর সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, কেমোথেরাপি ওষুধ মস্তিষ্কের লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম অর্থাৎ বর্জ্য পরিষ্কার করা ও রোগপ্রতিরোধ কোষ স্থানান্তরের দায়িত্বে থাকা সূক্ষ্ম নালীগুলির কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এই সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে মস্তিষ্কে বিষাক্ত পদার্থ জমে গিয়ে স্মৃতি ও মনোযোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে কমিউনিকেশনস বায়োলজি জার্নালে। প্রধান গবেষক অধ্যাপক জেনিফার মানসন ও ভার্জিনিয়া টেকের ফ্রালিন বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক জানান, এই লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম আগে থেকেই আলঝাইমার বা মস্তিষ্কে আঘাতজনিত স্মৃতিক্ষয়ের মতো সমস্যার সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, কেমোথেরাপিও মস্তিষ্কের লিম্ফ্যাটিক প্রবাহকে দুর্বল করে। নারীরা বিশেষত বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডোসেট্যাক্সেল জাতীয় ওষুধে।

মানসন ও তাঁর সহকর্মী ড. মনেট রবার্টস একটি ত্রিস্তর গবেষণা মডেল তৈরি করেন ইঁদুর এবং মানব কোষকলা প্রকৌশল করা মস্তিষ্কের নমুনা ব্যবহার করে। তাঁরা দুইটি প্রচলিত কেমোথেরাপির ওষুধ,যথা – ডোসেট্যাক্সেল এবং কার্বোপ্লাটিন—এর প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। দেখা যায়, বিশেষ করে ডোসেট্যাক্সেল ওষুধ মস্তিষ্কের লিম্ফ্যাটিক নালীগুলো সংকুচিত করে দেয় এবং তাদের শাখা-প্রশাখা কমে যায়, যা এগুলোর পুনর্গঠন ও স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ক্ষতিকর।

ইঁদুরের মস্তিষ্কে ইমেজিং পরীক্ষায়ও দেখা যায়, লিম্ফ্যাটিক ড্রেনেজ/ তরল নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া কমে গেছে। একইসঙ্গে মেমরি টেস্টে দেখা গেছে ঐ ইঁদুরগুলোর স্মৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানসনের মতে, এই ফলাফল স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে “কেমো ব্রেন”-এর মূল কারণ হতে পারে মস্তিষ্কে বর্জ্য নিষ্কাশনের ঘাটতি।

তিনি বলেন, এখন তাঁরা ধরতে পেরেছেন ঠিক সমস্যাটি কোথায়, এবার সমাধান খুঁজে বের করাই হবে পরবর্তী ধাপ। হয়তো এমন কোনো প্রোটিন বা ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে যা একাধারে এই প্রবাহ পুনরুদ্ধারও করবে, আবার কেমোথেরাপির কার্যকারিতায় কোনো বাধাও পড়বে না। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, নারীরা পুরুষদের তুলনায় “কেমো ব্রেনে”বেশি আক্রান্ত হন, এবং এই লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের কারণ বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

ক্যান্সারের চিকিৎসার লক্ষ্য শুধুমাত্র জীবনের মেয়াদ বাড়ানো নয় – রোগীর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও স্নায়বিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

 

সূত্র : “Demonstration of chemotherapeutic-mediated changes in meningeal lymphatics in vitro, ex vivo, and in vivo” by L. Monet Roberts, Jennifer Munson, et.al;(13.10.2025), Communications Biology.

DOI: 10.1038/s42003-025-08784-4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen + four =