ক্যানসার কোষের ‘আণবিক সুইচ’

ক্যানসার কোষের ‘আণবিক সুইচ’

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

শরীরের কোষ প্রতিদিন নানা ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়। যেমন, অক্সিজেনের ঘাটতি, তাপমাত্রার পরিবর্তন, বিষাক্ত পরিবেশ ইত্যাদি। কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি মারাও যেতে পারে। তাই টিকে থাকতে, কোষকে দ্রুত নিজের সক্রিয় জিনগুলিকে বদলে নিতে হয়। ক্যানসার কোষের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র। টিউমারের আশেপাশের পরিবেশ সাধারণত অস্থিতিশীল, অক্সিজেন কম, পুষ্টির ঘাটতি বেশি এবং চাপপূর্ণ। তবুও আশ্চর্যের বিষয়, ক্যানসার কোষ এগুলিকে ছাপিয়ে তরতর করে বাড়তে থাকে। তারা এমন জিনকে সক্রিয় করে যা টিউমারকে বড় হতে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।

কিন্তু এতদিন বিজ্ঞানীরা জানতেন না ঠিক কীভাবে ক্যানসার কোষ এই প্রতিকূল সংকেতগুলোকে কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকে ও বৃদ্ধি পায়। নিউইয়র্কের রকিফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এই রহস্যের খোঁজে নেমে আবিষ্কার করেছেন ক্যানসার কোষের ভেতরের এক ‘আণবিক সুইচ’, যা প্রতিরোধী পরিস্থিতিতে জিন-নিয়ন্ত্রণের দিক ঘুরিয়ে দেয়। প্রধান গবেষক রান লিন জানান, “আমরা এমন এক নতুন ট্রান্সক্রিপশন-স্তরের প্রক্রিয়া শনাক্ত করেছি, যা ক্যানসার কোষকে কঠিন পরিস্থিতিতেও বাঁচিয়ে রাখে। এই পথ বন্ধ করা গেলে ক্যানসার কোষের বেঁচে থাকার কৌশল ভেঙে দেওয়া যাবে।”

এই আণবিক সুইচটি তৈরি হয় কোষের এক সাধারণ ট্রান্সক্রিপশন সমগ্র থেকে। যেটি সাধারণত সব ধরনের প্রোটিন-তৈরির জিন চালু করতে প্রয়োজনে আসে। ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট রোডার বলছেন, “আমরা অবাক হয়েছি, এই কমপ্লেক্সের আলাদা উপাদানগুলিকে ক্যানসার কোষ নিজেদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে নেয়। বিশেষ করে এমন কাজে, যা তাদের কঠিন পরিবেশেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।” নিউক্লিয়াস যুক্ত কোষে প্রোটিন-তৈরির জিনগুলোর অনুলিপি তৈরি করে এক বিশেষ উৎসেচক – আরএনএ পলিমারেজ–২ বা পল–২। রোডারই প্রথম এই উৎসেচক আবিষ্কার করেন। ‘পল–২’এর কাজ শুরু করতে সাহায্য করে মধ্যস্থতাকারী সমগ্র। এটি একটি ৩০ উপাদানযুক্ত বড় কো-অ্যাক্টিভেটর। মধ্যস্থতাকারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ‘এমইডি-১ (MED1)’। এটি বহু কোষে, পল–২ দ্বারা জিন প্রকাশের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে, ইস্ট্রোজেন-রিসেপ্টর + (ER+) স্তন ক্যানসারে MED1 প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রোডারের ল্যাব আগে দেখিয়েছে, ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর ও MED1 একসঙ্গে কাজ করলে জিন-সক্রিয়করণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে, ক্যানসারের কিছু ওষুধ কম কার্যকর হয়ে পরে। লিন প্রথম পরীক্ষা করেন, MED1 প্রকাশে অ্যাসিটাইলেশন ঘটে কিনা। অ্যাসিটাইলেশন হল, প্রোটিনে একটি অ্যাসিটাইল গ্রুপ যোগ হওয়া, যা প্রোটিনের কার্যকারিতা বদলে দিতে পারে। ক্যানসারের বৃদ্ধি,মেটাস্টেসিস (অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া) এবং ওষুধ প্রতিরোধে অ্যাসিটাইলেশনের ভূমিকা এখন সক্রিয় গবেষণার বিষয়। লিন পরীক্ষা করে দেখলেন, MED1–এর উপর অ্যাসিটাইল গ্রুপ যোগ হয়। এরপর আসে পরবর্তী প্রশ্ন, চাপের সময় এই পরিবর্তন কীভাবে তার আচরণ বদলায়? গবেষকেরা কোষকে বিভিন্ন ধরণের চাপের মধ্যে ফেলেন। অক্সিজেন কমে যাওয়া (হাইপোক্সিয়া), অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, তাপের-স্ট্রেস। দেখা যায়, স্ট্রেসের সময় SIRT1 নামে একটি প্রোটিন MED1 থেকে অ্যাসিটাইল গ্রুপ সরিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডি–অ্যাসিটাইলেশন। ডি–অ্যাসিটাইলেটেড MED1 পল–২–এর সাথে আরও কার্যকরভাবে জুড়ে যায়। কোষ তখন টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলোকে দ্রুত চালু করতে পারে। পরীক্ষাকে আরও নিশ্চিত করতে, গবেষকেরা এমন একটি MED1 তৈরি করেন, যার ছয়টি অ্যাসিটাইলেশন সাইটই বাদ। অর্থাৎ সেটি আর অ্যাসিটাইলেটেড হতে পারে না। এরপর ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাভাবিক MED1–কে সরিয়ে ER+ ক্যানসার কোষে এই পরিবর্তিত MED1 বসানো হয়। স্ট্রেসে ডি–অ্যাসিটাইলেটেড MED1 হোক বা জন্ম থেকেই অ্যাসিটাইলেশনহীন MED1 হোক, দুটিতেই ক্যানসার কোষ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং স্ট্রেস বেশি সহ্য করতে পারে। গবেষকেরা আশা করছেন, স্ট্রেস-নির্ভর জিন-পরিবর্তনের এই পথকে আটকাতে পারলে বিশেষ করে ER+ স্তন ক্যানসারে নতুন ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।

 

সূত্র : Ran Lin, Yan Mo, Douglas Barrows, Wenbin Mei, Takashi Onikubo, Jianfeng Sun, Zhiguo Zhang, Effie Apostolou, Sohail F. Tavazoie, Robert G. Roeder. MED1 IDR deacetylation controls stress responsive genes through RNA Pol II recruitment. Nature Chemical Biology, 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 2 =