ক্রমোষ্ণ সুমেরুতে টিকে থাকার লড়াই 

ক্রমোষ্ণ সুমেরুতে টিকে থাকার লড়াই 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫

সুমেরু অঞ্চলের উষ্ণায়নের সবচেয়ে পরিচিত প্রতীক হলো মেরু ভাল্লুক। ক্রমশ গলতে থাকা সমুদ্রের বরফ, খাদ্যের সংকট এবং বিচ্ছিন্ন আবাসস্থল , এই সবকিছু মিলিয়ে তাদের অস্তিত্ব আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। তবে সাম্প্রতিক এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের কিছু মেরু ভাল্লুক এই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেদের শরীরের গভীরে, অর্থাৎ ডিএনএ স্তরেই পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার গবেষকেরা গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব (১২টি) ও দক্ষিণ-পূর্ব (৫টি) অঞ্চলের মেরু ভাল্লুকের রক্তের নমুনা বিশ্লেষণ করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল তথাকথিত ‘জাম্পিং জিন’ বা ট্রান্সপোজন। অর্থাৎ ডিএনএ-র সেই ক্ষুদ্র, চলনশীল অংশ, যা অন্য জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গবেষকেরা এই জিনগুলোর কার্যকলাপ, তাপমাত্রার পার্থক্য এবং জিনের প্রকাশভঙ্গির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে দেখেন।

দেখা গেছে, উত্তর-পূর্ব গ্রিনল্যান্ড তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা ও স্থিতিশীল হলেও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল অনেক বেশি উষ্ণ এবং সেখানে সামুদ্রিক বরফ গলনের হারও কম। এই পরিবেশ ভবিষ্যতে পুরো সুমেরু অঞ্চলে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তারই এক বাস্তব নমুনা। এই ভিন্ন পরিবেশে বসবাসকারী মেরু ভাল্লুকদের শরীরে তাপজনিত চাপ, বার্ধক্য ও বিপাকের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ জিন ভিন্নভাবে কাজ করছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, চর্বি প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত জিনের প্রকাশে পরিবর্তন। খাদ্যের অভাবের সময় এই ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর মেরুর মেরু ভাল্লুকেরা যেখানে প্রধানত উচ্চ চর্বিযুক্ত সীল মাছের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের ভাল্লুকেরা ধীরে ধীরে তুলনামূলকভাবে কম চর্বিযুক্ত, কখনও উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখছে। এই অভিযোজনই তাদের জিনগত পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

আর এন এ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কোন জিন সক্রিয় রয়েছে, তার একটি বিশদ চিত্র পান। এতে দেখা যায়, ডিএনএ-র কিছু অংশে জাম্পিং জিন অত্যন্ত সক্রিয়, এমনকি প্রোটিন তৈরির অংশেও এদের উপস্থিতি রয়েছে। গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী ড. অ্যালিস গডেনের মতে, এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে মেরু ভাল্লুকেরা দ্রুত মৌলিক জেনেটিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা বিলীয়মান সমুদ্রবরফের পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।

এই গবেষণা আগের এক সমীক্ষাকেও সমর্থন করে। সেখানে দেখা গিয়েছিল যে দক্ষিণ-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের মেরু ভাল্লুকেরা প্রায় ২০০ বছর আগে উত্তর-পূর্বের দল থেকে আলাদা হয়ে জিনগতভাবে ভিন্ন পথে এগিয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মেরু ভাল্লুক বিলুপ্ত হতে পারে। তাই এই গবেষণা। তবে এই অভিযোজন আশার আলো দেখালেও, বিপদের মেঘ কাটেনি। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বর্তমান উষ্ণায়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মেরু ভাল্লুক বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সময় থাকতে থাকতে এই অমূল্য প্রাণীটিকে রক্ষা না করলে অভিযোজনের শক্তিও একদিন হার মানবে।

 

সূত্র: Diverging transposon activity among polar bear sub-populations inhabiting different climate zones, by Alice Godden, Benjamin Rix and Simone Immler, is published in the journal Mobile DNA on December 12, 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 2 =