
জমি হারাচ্ছে উর্বরতা, বনভূমি বিলীন হচ্ছে, আর জীববৈচিত্র্যও ভেঙে পড়ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা যদি খাদ্য উৎপাদন, খরচ ও অপচয়ের ধরন বদলাই, তবে শুধু ক্ষতি থামানোই নয়, বরং হারানো জমিও ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সম্প্রতি, ২১ জন বিজ্ঞানী এ বিষয়ে একটি বিশদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, খাদ্য অপচয় কমানো এবং টেকসই সমুদ্রভিত্তিক খাদ্য (যেমন মাছ ও সামুদ্রিক শ্যাওলা) খাওয়া বাড়ালে মহাদেশ জুড়ে জমির ব্যবহার কম করা সম্ভব হবে। এর সঙ্গে ‘পুনরুদ্ধার কর্মসূচি’ যুক্ত হলে জলবায়ু সংকট ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসকেও উল্টোদিকে ঘোরানো যাবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে পৃথিবীর সু-স্বাস্থ্য। গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও জমি-সংরক্ষণ কর্মসূচিতে খাদ্যব্যবস্থাকে এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ দ্রুত ও সমন্বিত খাদ্য সংস্কার হলে জমির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব। তারা প্রস্তাব করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আশু লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ পুনরুদ্ধার করা। এতে প্রায় ৫০ লাখ বর্গমাইল জমি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। যার মধ্যে ১১.৬ লাখ বর্গমাইল কৃষিজমি এবং ৩৮.৬ লাখ বর্গমাইল অ-কৃষি জমি।
এই পুনরুদ্ধার কাজের নেতৃত্ব দিতে হবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর। যেমন আদিবাসী, ক্ষুদ্র কৃষক, নারী ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের উপযুক্ত প্রযুক্তি, জমির অধিকার, বাজারে প্রবেশাধিকার ও সহায়ক ভর্তুকি নিশ্চিত করতে হবে। নীতি হতে হবে এমন, যা জমি ধ্বংস না করে সংরক্ষণের জন্য কৃষককে পুরস্কৃত করবে।
ভোক্তাদের জন্য স্বচ্ছ লেবেল, উন্নত তথ্য পর্যবেক্ষণ, আর ন্যায্য করনীতি দরকার, যাতে টেকসই উৎপাদনকারী লাভবান হয়। বিশ্বের প্রায় ২১.৮ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত, অথচ এর এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যায়। ১৪ শতাংশ মাঠ থেকে সংগ্রহের পর ১৯ শতাংশ চলে যায় দোকান, রেস্তোরাঁ বা ঘর তৈরিতে। যদি অপচয় ৭৫ শতাংশ কমানো যায়, তবে ৫.১৭ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি মুক্ত রাখা সম্ভব। এ জমি নতুন করে চাষ বা পশুচারণের জন্য ব্যবহার হবে না।
নীতিমালা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদ্য দান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। শীঘ্রই মেয়াদ ফুরোতে চলা খাবার ছাড়মূল্যে বিক্রয় চালু করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ছোট কৃষকদের জন্য উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও হিমঘর শৃঙ্খল তৈরি করতে হবে। স্পেনে ইতিমধ্যেই আইন করা হয়েছে, দোকানগুলোকে অতিরিক্ত খাবার দান বা বিক্রি করতে হবে। রেস্তোরাঁগুলোকে গ্রাহকদের জন্য অর্ডার করা বাড়তি খাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমাধান হল টেকসই সমুদ্রভিত্তিক খাদ্য। উদাহরণস্বরূপ, সী-উইড (সামুদ্রিক শ্যাওলা) বেড়ে ওঠার সময় কার্বন শোষণ করে এবং কোনো মিষ্টি জলের প্রয়োজন হয় না। যদি বিশ্বে অনিরাপদ লাল মাংসের ৭০ শতাংশের বদলে টেকসই সামুদ্রিক খাদ্য ব্যবহার করা যায়, তবে ৬.৬ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি রক্ষা পাবে। শুধু ১০ শতাংশ শাকসবজির পরিবর্তে সামুদ্রিক শ্যাওলাজাত খাবার খেলে আরও ১.৫৪ লাখ বর্গমাইল জমি মুক্ত হবে।তবে মনে রাখতে হবে, ধনী দেশ, যেখানে অতিরিক্ত মাংস খাওয়া হয়, সেখানেই পরিবর্তন আনা সবচেয়ে জরুরি। দরিদ্র দেশগুলি, যেখানে প্রাণিজ খাদ্য পুষ্টির জন্য অপরিহার্য, সেখানে পরিবর্তন হতে হবে সুষম ও ন্যায়সঙ্গত। বার্তাটি স্পষ্ট: খাদ্যব্যবস্থা ঠিক করুন, জমি বাঁচবে।
সুতরাং খাদ্য অপচয় হ্রাস এবং সমুদ্রভিত্তিক খাদ্য বৃদ্ধি—এই দুটি বড় পদক্ষেপ ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১১.৯ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি রক্ষা করতে পারে, যা প্রায় আফ্রিকা মহাদেশের সমান। এর সঙ্গে যদি ক্ষয়প্রাপ্ত জমির অর্ধেক পুনরুদ্ধার করা যায়, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট ১৬.৯ মিলিয়ন বর্গমাইল জমি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার সম্ভব। ফলে, বছরে প্রায় ১৩ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমতুল্য নিঃসরণ কমানো যাবে। জীববৈচিত্র্যও উপকৃত হবে, কারণ প্রাকৃতিক আবাসস্থল পুনরুদ্ধার হবে এবং নতুন করে জমি রূপান্তরের চাপ কমবে। মাটি, জলাধার এবং খাদ্যাভ্যাস উন্নত হলে বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যও শক্তিশালী হবে।।গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রসংঘের তিনটি বড় কনভেনশনের (জীববৈচিত্র্য, মরুকরণ, জলবায়ু) খাদ্য ও জমি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। বিজ্ঞান থেকে নীতি তৈরি দ্রুত করতে হবে, অগ্রগতি পরিমাপ করতে হবে, এবং বৈশ্বিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। জাতিসংঘের Convention to Combat Desertification (UNCCD) ইতিমধ্যেই কৃষিজমিতে ক্ষয় রোধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সূত্র : Bending the curve of land degradation to achieve global environmental goals by
Fernando T. Maestre, et.al ; Nature (13 August , 2025)