
আমাদের কখন খিদে পায়, কখন তেষ্টা পায়, তার জন্য মস্তিস্ক একটি জটিল স্নায়বিক প্রণালী ব্যবহার করে। তবে মস্তিষ্ক কিভাবে শরীরের প্রয়োজন বুঝে সেগুলোকে কাজে রূপান্তরিত করে, তা নিয়ে এখনও অনেক কিছু অজানা। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স এবং রেগেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একত্রে মস্তিষ্কর ‘অ্যামিগডালা’ অঞ্চলে কিছু বিশেষ স্নায়ুকোষের গোষ্ঠী খুঁজে পেয়েছেন, যা এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খিদে ও তেষ্টার সাথে জড়িত স্নায়ুকোষগুলি আলাদা বর্তনী মারফত কাজ করে। এগুলো শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলিকে প্রভাবিত করে। ইঁদুরের উপর করা এই গবেষণাটি থেকে পুষ্টির প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণে অ্যমিগডালার ভূমিকা সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বেরিয়ে এসেছে। শুধু খিদে পাওয়া নয় বরং খাবারের সাথে জড়িত কোনো রোগ বা আসক্তির ব্যাপারেও তথ্য দিতে পারে গবেষণাটি। অ্যামিগডালা হল আবেগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে যুক্ত মস্তিষ্কর একটি অঞ্চল। এটি খাবার ও পানীয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অ্যামিগডালার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তৃষ্ণার্ততার জন্য বিশেষ স্নায়ুকোষের গোষ্ঠী রয়েছে, যা জটিল সংকেত দ্বারা পরিচালিত হয়। গবেষক ফেডেরিকা ফার্মানি বলেছেন, “এই স্নায়ুকোষগুলির একটি গোষ্ঠী পানীয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ‘তৃষ্ণা নিউরন’ নামে পরিচিত। দেখা যায়, যখন এই স্নায়ুকোষগুলি সক্রিয় হয়, তখন ইঁদুরগুলি বেশি করে জল পান করে। আর স্নায়ুকোষগুলি নিষ্ক্রিয় থাকলে, তারা কম জল পান করে। খিদে ও তেষ্টার অনুভূতি জাগায় এমন দুই স্নায়ুকোষ-গোষ্ঠীর পাশাপাশি তাঁরা আরেকটি স্নায়ুকোষ-গোষ্ঠীও চিহ্নিত করেছেন। এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ স্নায়ুকোষ খাবার ও পানীয়ের পছন্দ নির্দেশ করে। অর্থাৎ, অ্যামিগডালার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, স্নায়ুকোষের খাদ্য সংশ্লিষ্ট অনুভূতির সাথে জড়িয়ে থাকে। সুস্বাদু খাবারের প্রতি ইতিবাচক আবেগ এবং বিস্বাদ খাবারের প্রতি বিরাগ তৈরি করে। গবেষকরা দেখেছেন, এই স্নায়ুকোষগুলির কার্যকলাপ বদলে গেলে ইঁদুরদের আচরণও বদলে যায়। এমনকি তারা অসুস্থ থাকলেও, খাবারের প্রতি তাদের উৎসাহ থাকে। গবেষকরা ইঁদুরের খিদে ও তেষ্টা নিয়ে তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ অধ্যয়ন করতে উন্নত জিনগত সরঞ্জাম ব্যবহার করেছেন। অপটোজেনেটিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁরা নির্দিষ্ট নিউরনগুলোকে আলো-সংবেদনশীল প্রোটিন ও লেজারের মাধ্যমে সক্রিয় করেন। তাঁরা নিউরনগুলোকে থামিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিও ব্যবহার করেছেন, যাতে নিউরনের অনুপস্থিতি ইঁদুরদের মধ্যে খাবার খাওয়া বা জল পান করার প্রবণতাকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা দেখা যায়। নিউরনগুলো মস্তিষ্কের অন্য অংশের সাথেও যোগাযোগের পথ দেখে, যা খাদ্য ও জলের অনুভূতির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। যেমন মস্তিষ্কর প্যারাব্র্যাকিয়াল কমপ্লেক্স নামক অংশ, যার কাজ হল সংবেদনী তথ্যকে পুরোমস্তিষ্কয় রিলে করে দেওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্ক স্বাদের মতো বিষয়গুলির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে, যা আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, কম পছন্দের পানীয়ের স্বাদকে অ্যামিগডালার নিউরনের উদ্দীপনার সাথে যুক্ত করে গবেষকরা ইঁদুরের পছন্দ পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। এমনকি পূর্বে এড়িয়ে চলা স্বাদকেও নতুন করে তাদের ‘প্রিয়’ স্বাদে রূপান্তরিত করতে পারেন। ইঁদুর ও মানুষের অ্যামিগডালার গঠন একই রকম হওয়ায়, গবেষকরা মনে করেন যে এই ফলাফলগুলি আমাদের খাদ্য ও পানীয়ের অভ্যাসেও আবেগ ও প্রেরণার প্রভাবকে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। রুডিগার ক্লেইন বলেন, “খিদে ও তেষ্টার আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করে দেয় যে আমরা সঠিক সময়ে খাবার খাই ও জল পান করি। ফলে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জল ও পুষ্টি পাওয়া যায়। কিন্তু এই স্নায়ু অঞ্চলগুলি মস্তিষ্কের সংকেতের উপর নির্ভর করে অতিরিক্ত বা কম খাওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়াগুলোর রহস্য ভেদ করলে আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারব কি করে মস্তিষ্ক খাদ্য আর পানীয়র আবেগ ঘটিত মূল্যায়ন করে, কিকরে এদের তৃপ্তি আর বিরাগের সঙ্গে জড়িত করে। কিকরে স্নায়বিক বিকাশ অন্তরনিহিত আর অজিত আচরণ কে রূপ দেয়। গবেষণাটি নতুন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, যেমন মস্তিষ্ক কিভাবে খিদে ও তেষ্টা এবং আবেগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে? আমরা কিভাবে জানি যে খুব কম বা খুব বেশি খাচ্ছি ও পান করছি? প্রতিযোগী প্রয়োজনগুলো কিভাবে পরিচালিত হয়? কিভাবে এই মস্তিষ্কর বর্তনীগুলি স্থূলতা, ক্ষুধামান্দ্য, বা মদ্যপানের মতো বিষয়ে প্রভাব ফেলে? পরবর্তী গবেষণার দিকে তাকিয়ে আমরা।