খুকুমণির ইখতিওসর আবিষ্কার

খুকুমণির ইখতিওসর আবিষ্কার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২২ এপ্রিল, ২০২৫

পরিচিত সাগরবেলায় ঘুরতে ঘুরতে, আবিষ্কার হয়ে গেল ইখথিওসরের ধ্বংসাবশেষ। খুঁজে পেল কে? ১১ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে রুবি রেনল্ড্স এবং তার বাবা জাস্টিন। ২০২০ সালের মে মাসের শেষের দিকে, ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল সামারসেটে একটি জীবাশ্ময় তারা হোঁচট খেলেন, তার নীচের চোয়াল সাড়ে ছয় ফুটের বেশি লম্বা। ২০২ কোটি বছর আগের ট্রায়াসিক যুগের ইখথিওসরের জীবাশ্ম এটি। ছোট্ট মেয়েটি আর তার বাবা জীবাশ্মের সন্ধানে ব্লু অ্যাঙ্কারের কাদামাটির দিকে রওনা হলেন। জাস্টিন প্রথমে চার ইঞ্চির একটি হাড়ের টুকরো দেখতে পান। সেই হাড় সম্পর্কিত আরো টুকরোর অনুসন্ধানে নেমে রুবি খুঁজে পেল তার চেয়ে দ্বিগুণ আকারের আরো একটি টুকরো। এরপর ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ ডিন লো লোম্যাক্সের কাছে এই খবর পৌঁছল। ২০১৬ সালে স্থানীয় সংগ্রাহক পল দে লা স্যালের তোলা আরেকটি সমারসেট নমুনার প্রতিচ্ছবি এই হাড়ের টুকরোটি। আসলে বর্তমান ব্রিটেনের বেশিরভাগ অংশই একদা ছিল উষ্ণ অগভীর সমুদ্রের নীচে। যেখানেছিল মাংসখেকো এই ডাইনোসরগুলির বাস। তাদের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে এক গণবিলুপ্তির ঘটনার মধ্য দিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাড়গুলিই তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ। রুবির এই আবিষ্কারের নামকরণ করা হয় ‘ইখথিওটিটান সেভারেনসিস’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘সেভারনের বিশাল মৎস্য সদৃশ্য সরীসৃপ’। ২০১৮ সালে পল দে লা প্রাপ্ত হাড়ের টুকরোটি দেখে লোমাক্স জানান, “হাড়ের ক্ষয়প্রাপ্ত প্রান্তগুলি ইঙ্গিত দেয়, খুব বড় কিছু আবিষ্কার হতে চলেছে। ভবিষ্যতে, আরও নমুনা আবিষ্কৃত হবে”, লোম্যাক্স তার আশা ব্যক্ত করেন। রুবি এবং জাস্টিন সমুদ্র সৈকত থেকে আনা জিনিসপত্রের ছবি ইমেইল করার পর লোম্যাক্স জানান, “আপনারা বিশাল এক ইখথিওসরের চোয়ালের হাড় খুঁজে পেয়েছেন”। এর পরেই গবেষণা দলটি সমারসেটের দিকে ছুটে যায়। পল, রুবি এবং জাস্টিন সকলের সংগৃহীত হাড়ের টুকরোগুলিকে একত্রিত করে দেখা যায়, এগুলি একটি ইখথিওসরেরই। নতুন সংগ্রহের সময় আরো কিছু টুকরো উদ্ধার করা হয়। যার ফলে, চোয়ালের দুই তৃতীয়াংশ অক্ষত এবং চমৎকার অবস্থায় সংগৃহীত করা গেছে। দুটি সমারসেট চোয়ালের তুলনা করে, উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায়। উভয়কেই একই শিলাস্তরে পাওয়া গেছে এবং অস্বাভাবিক আভ্যন্তরীণ হাড়ের গঠন নির্দেশ করে।মনে হচ্ছে, এটি কোন নতুন প্রজাতিরও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে! ‘প্লস ওয়ান’ এ প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তারা বর্ণনা করেছেন, প্রাণীটি প্রায় ৮২ ফুট লম্বা ছিল- প্রায় একটি তিমির সমান। বিজ্ঞানীরা হাড়ের ভিতরের আণুবীক্ষণিক কাঠামো পরীক্ষা করছেন। ইখথিওটিটান শান্তাসর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই গোষ্ঠী একসময় বিশ্ব জুড়ে ট্রায়াসিক লেভিয়াথান তৈরি করেছিল। তবে সম্পূর্ণ কঙ্কাল উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সবটাই অনিশ্চিত। খোলা সমুদ্র ভ্রমণের সুবিধার জন্য সামারসেট টাইটানদের গঠন ছিল হালকা এবং সুবিন্যস্ত । এদের চোয়ালের হাড় একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির চেয়ে কয়েক ফুট বড়। এর সাথে যদি এদের নিকট আত্মীয় সোনিসোরাসের তুলনা করা হয়, তাহলে খুলিটি ১০ ফুটেরও বেশি বিস্তৃত এবং পাখনা আকৃতির ফ্লিপার ছিল, যা অনেকখানি প্রশস্ত। এদের এত বড় চেহারা সমুদ্রে খাদ্যের সমৃদ্ধি এবং অন্যান্য শিকারির অনুপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ট্রায়াসিক জলে স্কুইডের মতন বিশাল সন্ধিপদদের দলগুলি বেড়ে ওঠে, যা দীর্ঘ সময় ধরে শিকারিদের ভোজের পাত্র ছিল। অন্যান্য ইখথিওসরের আইসোটোপ পরীক্ষা থেকে জানা যায়, এদের উষ্ণ রক্ত যুক্ত বিপাকক্রিয়া ছিল। এদের মসৃণ দেহের সাদৃশ্য, তিমির মতন বিশেষ বাস স্থানের উপযোগী ছিল। ডাইনোসরদের পাশাপাশি ট্রায়াসিকরা ঘুরে বেড়াতো। এই কারণে, জৈবযন্ত্রবিদ কেলসি স্টিলসন এই যুগকে ‘অদ্ভুত সময়’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন “পৃথিবীর বিবর্তনের এই বৃহত্তর চিত্রটি আমাদের কল্পনার বাইরে”। ইখথিওসররা শেষ পার্মিয়ান গণবিলুপ্তির পরে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রায় ৯৪ কোটি বছর আগে এরা অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে এদের শূন্যস্থান বেশিদিন শূন্য ছিল না। প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে খুরওয়ালা স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সমুদ্রে ফিরে আসে। এবং তিমিরা টাইটানিক আকারের নিজস্ব পথে যাত্রা শুরু করে। আধুনিক নীল তিমি এখন ১০০ ফুটেরও বেশি লম্বা এবং ওজনে ১৮০ টন। এদের কাহিনী গুলি সমুদ্রের বিশাল প্রাণীদের লালন পালনের ক্ষমতা তুলে ধরে। প্রতি শীতে সামারসেটের পাহাড়ের ঢালগুলি বেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ঝড়ের কারণে, প্রাচীন কাদাপাথর ভেঙে রাতারাতি নতুন জীবাশ্মের সন্ধান করে দেয়। গবেষণাটি ৮ বছর ধরে চলছে। উপসংহারে লোম্যাক্স বলেন, “ভাবতেও অসাধারণ লাগে যে ট্রায়াসিক যুগে যুক্তরাজ্যের আশেপাশের বিশালাকার নীল তিমির আকারে ইখথিওসররা সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতো”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 1 =