
বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন গরিলারা শিম্পাঞ্জিদের তুলনায় কম আত্মসচেতন। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, গরিলারাও নিজেদের সম্পর্কে বোঝার ক্ষমতা রাখে, ঠিক যেমন শিম্পাঞ্জিরা রাখে।এর আগে, বিজ্ঞানীরা গরিলাদের পরীক্ষা করতেন আয়না পরীক্ষার মাধ্যমে । এতে দেখা হতো তারা আয়নায় নিজেদের চিনতে পারে কি না। শিম্পাঞ্জিরা এই পরীক্ষা পাস করলেও, গরিলারা সাধারণত পারেনি। তাই মনে করা হতো গরিলারা অপেক্ষা কৃত কম আত্মসচেতন।উট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বার্গার্স চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জি ও গরিলাদের নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন।গবেষণায় দেখা গেছে গরিলারা শিম্পাঞ্জির মতোই তাদের নিজের দেহকে বাধা হিসেবে চিনতে সক্ষম ।বিজ্ঞানীরা প্রাণীদের আত্মসচেতনতা বোঝার জন্য “আয়না পরীক্ষা” ব্যবহার করেছেন। এই পরীক্ষায় প্রাণীর শরীরে একটি ছোট চিহ্ন দেওয়া হয় যা সে শুধুমাত্র আয়নায় দেখলেই বুঝতে পারবে। প্রাণীটি আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সেই চিহ্নটি ছুঁতে বা সরানোর চেষ্টা করলে বোঝা যায় যে সে নিজেকে চিনতে পেরেছে।তবে গবেষক জর্গ ম্যাসেন বলছেন এই পরীক্ষা সব প্রাণীর জন্য উপযুক্ত নয়। কিছু প্রাণী দৃষ্টির ওপর খুব বেশি নির্ভর করে না বলে আয়নার দিকে তাকাতেও পছন্দ করে না। আবার গরিলার মতো কিছু প্রাণী চোখে চোখ রেখে তাকানো এড়িয়ে চলে, তাই তারা আত্ম সচেতন হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষায় খারাপ ফল করতে পারে। কিন্তু এর থেকে কি প্রমাণিত হয় যে তারা আত্মসচেতন নয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গবেষক ম্যাসেন ও অন্যান্য গবেষকরা বিস্তর গবেষণা করেছেন।গরিলাদের শরীর সম্পর্কে সচেতনতা কতখানি তা জানার জন্য গবেষকরা একটি নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি করেন।এই পরীক্ষায় গরিলা ও শিম্পাঞ্জিদের একটি বাক্স খুলে খাবার নিতে হতো। কিছু ক্ষেত্রে, বাক্সটি এমনভাবে রাখা হয়েছিল যে প্রাণীটিকে এর ঢাকনার ওপর বসতে হতো। খাবার পাওয়ার জন্য তাদের বুঝতে হতো যে তাদের নিজের শরীরই বাক্সটি খুলতে দিচ্ছে না।গবেষক জর্গ ম্যাসেন জানান -এটি শরীর সম্পর্কে সচেতনতার একটি সাধারণ ক্ষমতা। মানুষের ক্ষেত্রে এই দক্ষতা প্রায় দেড় বছর বয়সে বিকশিত হয়।গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী গরিলা ও শিম্পাঞ্জি দু- দলই কাজটি সমানভাবে বুঝতে পেরেছিল।এর থেকে প্রমাণিত হয় তারা নিজেদের শরীরকে বাধা হিসেবে চিনতে পারে। তাই গরিলারা আয়না পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারলেও বলা যায় না যে তারা আত্মসচেতন নয়।গবেষক ম্যাসেন ও তার দল মনে করেন প্রাণীদের আত্মসচেতনতা বোঝার জন্য শুধু আয়না পরীক্ষাই যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীদের আরও নতুন উপায়ে গবেষণা করা প্রয়োজন ।গবেষকরা জানান এই শরীর সচেতনতা পরীক্ষার মাধ্যমে তারা গরিলাদের মানসিক জগৎ সম্পর্কে আরও জানতে পেরেছেন।বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ব্যবহার করলে আত্মসচেতনতা কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা ভালোভাবে বোঝা যাবে।কিছু গবেষক মনে করেন, মানুষ ও বড় বানরদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মধ্যে আত্মসচেতনতা অনেক আগে থেকেই ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা ভিন্ন ভিন্ন বানর প্রজাতির মধ্যে আলাদাভাবে বিকশিত হয়েছে। গবেষকরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটান এবং অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে একই ধরনের আত্মসচেতনতা আছে কি না।গবেষক ম্যাসেন বলেন, সব ধরনের বানরের আত্মসচেতনতা একরকম হতে পারে, আবার ভিন্নও হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা করা সম্ভব হলে এগুলোর পার্থক্য আরও ভালোভাবে বুঝতে পারা যাবে।
এই গবেষণা প্রমাণ করে আমরা যেসব প্রাণীকে কম বুদ্ধিমান ভাবি, তারা আসলে আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তাশীল হতে পারে।আয়না পরীক্ষার বাইরে গিয়ে গবেষকরা প্রাণীদের আত্মসচেতনতা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন। আর এভাবেই তারা বুঝতে পারবেন, মানুষ কীভাবে নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়া শিখেছে।এই গবেষণার ফলাফল থেকে নতুন প্রশ্ন উঠে এসেছে—বানরদের আত্মসচেতনতা কীভাবে তৈরি হয়? যদি গরিলারা শিম্পাঞ্জিদের মতোই নিজেদের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়, কিন্তু আয়না পরীক্ষায় ভালো না করে, তাহলে এটা বোঝায় যে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী ভিন্নভাবে আত্মসচেতনতা প্রকাশ করতে পারে।এরফলে পুরোনো ধারণা নিয়েও সন্দেহ ওঠে যে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি চিনতে পারাই কি সত্যিই আত্মসচেতনতার একমাত্র প্রমাণ? ।শিম্পাঞ্জিরা হয়তো আয়নায় নিজেদের চিনতে পারে, কিন্তু গরিলারা তাদের শরীরের নড়াচড়া ও অবস্থান সম্পর্কে বেশি সচেতন।আরও বৃহত্তর গবেষণা হলে বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে বুঝতে পারবেন যে বিভিন্ন প্রাণী নিজেদের ও তাদের চারপাশের পরিবেশকে কীভাবে দেখে ও অনুভব করে।এই গবেষণাটি আমেরিকান জার্নাল অফ প্রাইমাটোলজি নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।