গাছের শিকড়ে স্পন্দন

গাছের শিকড়ে স্পন্দন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪

আমরা সকলে গাছেদের নিয়ে ভাবলেও তাদের শিকড় বাকড় নিয়ে সম্ভবত খুব একটা ভাবি না – হয়তো তারা মাটির তলায় থাকে বলে। তবুও তারা ক্রমাগত পৃথিবীর আকৃতি পরিবর্তন করে চলেছে। ভাবতে অবাক লাগে এই প্রক্রিয়াটি আমাদের নিজেদের বাগানেও ঘটে চলেছে, যেখানে গাছপালা তাদের অন্তহীন বৃদ্ধির জন্য এক অদৃশ্য প্রক্রিয়া ব্যবহার করে চলেছে। প্রায় ১৫ বছর আগে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে মূলের অগ্রভাগে অবস্থিত কিছু জিন বা আরও স্পষ্টভাবে বললে, কিছু জিন থেকে উত্পাদিত প্রোটিনের স্তরের আন্দোলন ঘটে বলে মনে করা হয়। যদিও এটি এখনও কিছুটা রহস্যাবৃত, তবে সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদের নতুন পথ দেখায়। আমরা জানি যে এই দোদুল্যমানতা শিকড়ের বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত একটি মৌলিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার একটি সাম্যক ধারণা কৃষকদের এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধরনের মাটি এবং জলবায়ুতে জন্মানোর জন্য সেরা উদ্ভিদ চয়ন করতে সহায়তা করবে। সারা বিশ্বে খরা এবং বন্যার মতো ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়ার কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে ফলত এটি বোঝা আরও গুরুত্বপূর্ণ যে কীভাবে গাছপালা আগের চেয়ে বেড়ে ওঠে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি বুঝতে, আমাদের কোশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া প্রক্রিয়াগুলো দেখতে হবে। কোশের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং জিনের ক্রিয়াকলাপে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই ক্রিয়াকলাপের মধ্যে কিছু বাহ্যিক সংকেতের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঘটে, যেমন আলো, তাপমাত্রা বা পুষ্টির প্রাপ্যতার পরিবর্তন। কিন্তু বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া আবার প্রতিটি উদ্ভিদের বিকাশমূলক প্রোগ্রামের অংশ, জিনে এনকোড করা।
কিছু কোশীয় প্রক্রিয়ার নিয়মিত আন্দোলন ঘটে- কয়েক ঘন্টা অন্তর অন্তর কিছু অণু ছন্দবদ্ধভাবে দেখা দেয় আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। সবচেয়ে সুপরিচিত উদাহরণ হল উদ্ভিদ ও প্রাণীর অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম। মূলের অগ্রভাগের এই জিনের দোলন বা স্পন্দন আবিষ্কৃত হওয়ার কিছু পরে, বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছিলেন যে এই স্পন্দনটি একটি অদৃশ্য চিহ্ন রেখে যায়। এই চিহ্নগুলো এমন জায়গায় থাকে যেখানে শিকড়গুলো পাশের দিকে বাড়তে পারে অর্থাৎ এই চিহ্ন নির্ধারণ করে মূল আকারে কীভাবে বৃদ্ধি পাবে। গবেষকদের অনুমান অক্সিন নামক একটি উদ্ভিদ হরমোন প্রক্রিয়াটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কিছু জিন কোডিং করে। চার্লস ডারউইন প্রায় ১০০ বছর আগে অক্সিনের অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন এবং এর রাসায়নিক গঠন নিশ্চিত করেছিলেন। অক্সিনের “লক্ষ্য” হল এই দোদুল্যমান জিনগুলো। যখন অক্সিন একটি কোশে প্রবেশ করে, তখন এই জিনগুলো আরও সক্রিয় হতে থাকে। এর মধ্যে কিছু জিন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। অক্সিন “রিপ্রেসার” অপসারণে সহায়তা করে অর্থাৎ সেই প্রোটিন সরিয়ে দেয় যা জিনের মধ্যে কার্যকলাপকে রোধ করে। আবার এই রিপ্রেসর তাদের ব্লক করা জিন দ্বারা সক্রিয় হয়। গবেষকদের অনুমান এই ফিডব্যাক লুপটি এই স্পন্দন বা দোলনকে সহায়তা করে। আমরা জানি ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের একটি জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অক্সিন কোশ থেকে কোশে চলাচল করে। আবার এই চলাচল নির্ভর করে আশেপাশের অক্সিনের স্তরের উপর। এটি আরেকটি ফিডব্যাক লুপ। ক্রমবর্ধমান শিকড়ের এই আন্দোলন ঘটে, যেখানে কোশ চক্রের ফলে অগ্রভাগে থাকা কোশগুলো ক্রমাগত বিভাজিত হয়। বিজ্ঞানীরা ডায়নামিকাল সিস্টেম থিওরি থেকে সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখানোর চেষ্টা করছেন কীভাবে অক্সিন প্যাটার্ন কোশ বিভাজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু রহস্যের সমাধান হয় না কারণ সব কোশের একই সময়ে বিভাজন হয়না, ফলত অক্সিনের আন্দোলন অনিয়মিত ভাবেই ঘটে। গবেষকরা দেখেন যে মূলের অগ্রভাগে জিনের দোলন মূলের বৃদ্ধির সাথে যুক্ত হতে পারে তবে মূলের স্টেম কোশ বিভাজনের সময়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও এখনও গোটা ঘটনাটি রহস্যময়, তবে এটি সম্ভবত একটি একক প্রক্রিয়ার জন্য ঘটে না বরং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ফলে মূলের অগ্রভাগ স্পন্দিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + 2 =