গাবা দাবিয়ে ভয় কমানো

গাবা দাবিয়ে ভয় কমানো

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ আগষ্ট, ২০২৫

ভয়ানক কিছু ঘটে গেলে আমাদের মস্তিষ্কে ভয়ের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কিন্তু সাধারণত বিপদ কেটে গেলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সেই ভয় ভুলে যায়। কিন্তু, পি টি এস ডি-তে ( পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) আক্রান্তদের মস্তিষ্ক ভয় ভুলতে পারে না। সেই আতঙ্ক তাদের বারবার মনে পড়ে বিপদ কেটে যাওয়ার পরও।
এই রোগটি সাধারণত হয় যখন কেউ চরম ভয়, আতঙ্ক, ব্যথা বা মানসিক আঘাতজনক কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বা ভোগ করে। এসব ঘটনা মস্তিষ্কে এত গভীর প্রভাব ফেলে যে, আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা বাধা পায়।
আমাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামক অংশটি আতঙ্ক বা ভয় নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কোনো আঘাতজনিত ঘটনা অ্যামিগডালাকে অতিসক্রিয় করে তোলে। ফলে বারবার মস্তিষ্ক ঝুঁকির সংকেত পাঠাতে থাকে। হয়তো আসলে তেমন কিছুই ঘটছে না, কিন্তু ঐ পুর্বের ভয়ংকর স্মৃতি মুছে না যাওয়ার কারণে বারবার ভীতির সঞ্চার হতে থাকে।
এই ঘটনা বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করেছে, কার্যকর চিকিৎসাকেও কঠিন করে তুলেছে। বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধগুলি শুধু সীমিত উপশমই দেয়। হয়তো আক্রান্তদের একটি ছোট অংশই তা থেকে উপকার পায়।

এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কে ক্ষত মেরামতকারী একধরণের তারকাকৃতি সহায়ক কোষ আছে, যার নাম অ্যাস্ট্রোসাইট । এই কোষ থেকে অতিরিক্ত গাবা (গামা-অ্যামিনো বিউটারিক অ্যাসিড) নিঃসরণ পি টি এস ডি রোগীদের মধ্যে ভয়ের স্মৃতি মুছে ফেলতে বাধা দেয়। গাবার কাজ মস্তিষ্ককে শান্ত রাখা, কিন্তু এর অতিরিক্ত নিঃসরণ আবার মস্তিষ্কে উল্টো প্রতিক্রিয়া জাগায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইনস্টিটিউট ফর বেসিক সায়েন্স (আই বি এস) এবং ই ডবলিউ মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তাঁরা একটি সম্ভাবনাময় ওষুধ KDS2010 শনাক্ত করেছেন যা এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রোসাইট কোষ MAOB (Monoamine Oxidase B) নামক এনজাইমের মাধ্যমে গাবা উৎপন্ন করে। এই অতিরিক্ত গাবা মস্তিষ্কের ভয় ,আবেগ, অনুভব সচেতনতা প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণকারী অংশে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং স্নায়বিক কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে ভয়জনিত স্মৃতি দূর করতে সমস্যা হয়, যা পি টি এস ডি রোগীদের ক্ষেত্রে একটি মূল সমস্যা। এই নতুন ওষুধটি MAOB-কে নির্দিষ্টভাবে প্রতিহত করে। এতে গাবা-র পরিমাণ কমে, মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয় ও ভয় দূর করার প্রক্রিয়া পুনরায় সক্রিয় হয়।
এই ওষুধ ইঁদুরের পি টি এস ডি -এর লক্ষণ হ্রাসে সফল হয়েছে। ইতিমধ্যে মানব দেহের ওপর প্রথম পর্বের পরীক্ষাও নিরাপদেই সম্পন্ন হয়েছে। এখন এটি নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষা চলছে। যদি এতে ইতিবাচক সাড়া মেলে, তবে তা ভবিষ্যতের পি টি এস ডির চিকিৎসায় এক নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করবে।
গবেষণাটি প্রায় ৩৮০ জন পি টি এস ডি রোগীর মস্তিষ্কের ইমেজিং বিশ্লেষণ করেছে। দেখা গেছে, তাদের মস্তিস্ক গাবার মাত্রা অস্বাভাবিক বেশি এবং রক্তপ্রবাহ কম। যেসব রোগী চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছেন, তাদের গাবার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে । অর্থাৎ, মস্তিষ্কের ভীতি নিয়ন্ত্রণে গাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মৌলিক।
এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর “রিভার্স ট্রান্সলেশনাল” পদ্ধতি। এতে প্রথমে মানুষের মস্তিষ্কের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সমস্যা চিহ্নিত করা হয় এবং পরে তা পশু মডেলে পরীক্ষা করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়েছে, অ্যাস্ট্রোসাইট দ্বারা নিঃসৃত গাবাই পি টি এস ডি-এর মূল কারণগুলোর একটি এবং MAOB নিরোধক ওষুধ এই সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে পারে।

এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে শুধু পি টি এস ডি নয়, প্যানিক ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন এবং স্কিজোফ্রেনিয়ার প্রভৃতি স্নায়ু -মানসিক রোগের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সূত্র: “Astrocytic gamma-aminobutyric acid dysregulation as a therapeutic target for posttraumatic stress disorder” by Sujung Yoon, Woojin Won, Suji Lee, et.al ( 28.7.2025), Signal Transduction and Targeted Therapy.
DOI: 10.1038/s41392-025-02317-5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − three =