গোষ্ঠীস্বার্থে পিঁপড়ের আত্মবলিদান 

গোষ্ঠীস্বার্থে পিঁপড়ের আত্মবলিদান 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

প্রাণীজগতে নিঃসন্দেহে পিঁপড়ে নিঃস্বার্থতার প্রতীক । নিজেদের কল্যাণ ভুলে কলোনির সুরক্ষাই তাদের মূল লক্ষ্য। অসুস্থ হলে তারা আলাদা হয়ে যায়, বিপদের মুখে নিরদ্বিধায় মরতেও প্রস্তুত। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, এই আত্মত্যাগের মানসিকতা আরও গভীর, আরও বিস্ময়কর। কারণ অনেক পিঁপড়ের শিশু—গুটি ( কীটপতঙ্গের তৈরি খোলস যার মধ্যে তারা এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তরের সময় নিরাপদে থাকে) ফোটার আগেই আত্মহত্যা করছে, শুধু যাতে বাকিরা নিরাপদ থাকে।

নেচার কমিউনিকেশান্স–এ প্রকাশিত নতুন গবেষণায় অস্ট্রিয়ার ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএসটিএ) বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লেসিয়াস নেগ্লেক্টাস প্রজাতির পিঁপড়েদের পিউপা বা গুটিবন্দী শিশুরা যদি মারণ ছত্রাক বীজাণু মেটারিজিয়াম ব্রুনিয়ামে আক্রান্ত হয়, তবে তারা গুটির ভেতর থেকেই এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। এই গন্ধটি সাধারণ কোনো দুর্গন্ধ নয়, এ এক মোক্ষম মৃত্যু সংক্রান্ত সতর্কবার্তা, যা কাছাকাছি থাকা প্রাপ্তবয়স্ক কর্মী পিঁপড়েদের জানিয়ে দেয় যে শিশুটি বাঁচবে না, কিন্তু তাকে এখনই হত্যা করলে পুরো বসতিটা রক্ষা পাবে।

গবেষকদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই সংকেত শুধু তখনই সক্রিয় হয়, যখন আশপাশে কর্মী পিঁপড়েরা থাকে। অর্থাৎ এটি নিছক রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়, বরং বসতির স্বার্থে সুনির্দিষ্টভাবে পাঠানো এক সংকেত। একে এক ধরনের চরম সামাজিক আত্মত্যাগের নিদর্শন বলা যায়।

আই এস টি এ–র প্রাণীবিজ্ঞানী এরিকা ডসন বলছেন,“মারণ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে নিজের মৃত্যুর বার্তা পাঠানো—এ এক চূড়ান্ত নিঃস্বার্থতা। এতে বসতি বেঁচে থাকে, আর পরোক্ষভাবে সেই পিঁপড়ের জিনও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে বেঁচে যায়।”

এই রাসায়নিক সতর্কবার্তাটি এতটাই সূক্ষ্ম যে এটি ভুলভাবে ছড়ালে অন্য সুস্থ পিঁপড়েদের মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই এর গঠনেও রয়েছে চমৎকার নৈপুণ্য। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব ভুর্ৎজবুর্গ–এর রাসায়নিক জীববিজ্ঞানী টমাস শ্মিট জানান, এটি উবে যাওয়া উদ্বায়ী গ্যাস নয়, বরং পিউপার গায়ে সেঁটে থাকা অনুদ্বায়ী যৌগ, যা সুনির্দিষ্টভাবে আক্রান্ত পিউপার সাথেই যুক্ত থাকে। ফলে অপ্রয়োজনীয় পিঁপড়ে হত্যা এড়ানো যায় এবং বসতির মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয় না।

আরও আশ্চর্যের বিষয়—এই আত্মহত্যামূলক সতর্কবার্তা সব পিঁপড়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই আচরণ কেবল কর্মী পিঁপড়ের সন্তানদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ভবিষ্যৎ রানী-পিউপারা তুলনামূলকভাবে বেশি রোগ-সহনশীল হওয়ায় তারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এবং তাই এ ধরনের সংকেত দেয় না—এটিও গবেষণায় স্পষ্ট।

 

আই এস টি এ–র পরিবেশবিজ্ঞানী সিলভিয়া ক্রেমার বলেন, “এটি ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্তরের এমন এক নিখুঁত সমন্বয়, যা পিঁপড়েদের অতি শক্তিশালী সামাজিক আচরণের সবচেয়ে পরিশীলিত উদাহরণ।”

গুটির ভিতরকার নরম অন্ধকারে, জন্মের আগেই নিজেকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করা এক অবিশ্বাস্য ত্যাগ। এই পিঁপড়েদের জীবনের প্রতিটি স্তরেই গোষ্ঠীর জন্য স্বার্থত্যাগ নির্মোহভাবে প্রোথিত।

সূত্র : Sick baby ants sacrifice themselves to save their colony

New research shows ill pupae emit a chemical signal before ever leaving their cocoons by Andrew Paul.

Published Dec 2, 2025 11:00 AM EST

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one + 13 =