গ্রহজন্মের নতুন তত্ত্ব

গ্রহজন্মের নতুন তত্ত্ব

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

একদা মনে করা হতো, গ্রহগুলি ধীরে ধীরে একটানা কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধূলিকণা জমাট বেঁধে তৈরি হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, এই জন্ম ছিল আসলে উত্তাল সংঘর্ষ, ধ্বংস, এবং পুনর্গঠনের ধারাবাহিক পরিণতি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানী দমনবীর সিং গ্রেওয়াল ও তাঁর সহকর্মীদের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণাটি উল্কাপিণ্ডের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছে সৌরজগতের প্রথম দিকের গ্রহগুলির গঠন প্রক্রিয়া ছিল বিশৃঙ্খল ও তীব্র বিস্ফোরক ।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১ থেকে ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে, সৌরজগতের প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হওয়া ছোট ছোট গ্রহাণুগুলো সংঘর্ষে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাদের কেন্দ্রস্থলের ধাতব পদার্থগুলি (বিশেষত লোহা ও সালফার) পৃথক হয়ে গলে গিয়েছিল, তারপর সেই ভগ্নাংশগুলো আবার জড়ো হয়ে নতুন দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রহদেহ তৈরি করেছিল।

এই প্রক্রিয়ায় তৈরি লৌহসমৃদ্ধ উল্কাপিণ্ডগুলিই আজ পৃথিবীতে খসে পড়ে আমাদের সেই উত্তাল অতীতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা লোহার উল্কাপিণ্ডে উপস্থিত ধাতুগুলির (যেমন: ওসমিয়াম, ইরিডিয়াম, প্লাটিনাম ও প্যালাডিয়াম) অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এগুলোর পরিবর্তন ঘটে সালফারযুক্ত তরলের উপস্থিতি ও পৃথকীকরণের সময়।

কিছু উল্কাপিণ্ডের কেন্দ্রে সালফারের উপস্থিতি নগণ্য, যা প্রমাণ করে যে প্রাথমিক সালফারযুক্ত ধাতব অংশ সংঘর্ষে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর পুনর্গঠনের সময় নতুন গলিত ধাতব কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। এ ছিল তুলনামূলকভাবে সালফারবিহীন ও নতুন রাসায়নিক উপাদানে সমৃদ্ধ।

বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যেমন- অ্যালুমিনিয়াম-২৬ ও হাফনিয়াম-১৮২ ব্যবহার করে এই প্রক্রিয়ার কাল নির্ধারণ করেছেন। এসব আইসোটোপ দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাই এগুলো সেই প্রচণ্ড তাপীয় গলনের স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সংঘর্ষ ও পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াগুলো ঘটেছিল সৌরজগতের জন্মের প্রথম ২ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই, যখন অ্যালুমিনিয়াম-২৬ সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ, আমাদের সৌরজগৎ জন্মকাল থেকেই ছিল উত্তপ্ত, অস্থির ও প্রাণবন্ত এক রাসায়নিক কারখানা।

এই আবিষ্কার গ্রহ গঠনের প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়েছে। আগের ধারণা ছিল, গ্রহগুলো একটানা গলন ও সংযোজনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে; কিন্তু নতুন মডেল বলছে এটা ছিল বহু ধাপে সংঘটিত এক উত্তাল লড়াইয়ের প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ায় প্রতিটি সংঘর্ষ কিছু অংশ ভেঙে দেয়, আর কিছু অংশ পুনরায় গলে নতুন দেহে যুক্ত হয়।

ফলে প্রাচীন গ্রহাণুগুলির কেন্দ্র বারবার পরিবর্তিত হয়েছিল – কখনও সালফারসমৃদ্ধ, কখনও সালফারবিহীন। এই প্রক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে আজকের পৃথিবী, মঙ্গল বা ধাতব উল্কাপিণ্ডগুলো।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অনেক উল্কাপিণ্ড আসলে দ্বিতীয় প্রজন্মের কেন্দ্র থেকে এসেছে। অর্থাৎ, এরা একবার ভেঙে পড়ে আবার গড়ে ওঠা প্রাচীন দেহের স্মৃতি বহন করছে। আমাদের আগের অনুমান অনুযায়ী তাদের মূল গ্রহদেহের আকার ও রাসায়নিক গঠন পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

সবশেষে গ্রেওয়াল বলেন, গ্রহের জন্ম একটানা নয়, বরং আগুন, সংঘর্ষ আর পুনর্জন্মের এক মস্ত অধ্যায় যেখানে প্রতিটি ভাঙনই ছিল নতুন সূচনা।

 

সূত্র : Protracted core formation and impact disruptions shaped the earliest outer Solar System planetesimals by Damanveer S. Grewal, Zhongtian Zhang,et.al; published in Science Advances.(1.10.2025).

DOI: 10.1126/sciadv.adw1668

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 5 =