
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এক অভাবনীয় ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন, যা তাদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধ্যান ধারণায় আঘাত হানে। দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের হার্ডার হিমবাহের নীচে বরফে ঢাকা একটি হ্রদ আচমকা ফেটে গিয়ে তীব্র জলের স্রোত বরফের পুরু স্তর ভেদ করে ওপরের দিকে উঠে আসে। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে প্রায় ২৩.৮ বিলিয়ন গ্যালন জল বেরিয়ে আসে, যা নয় ঘণ্টা ধরে পূর্ণ গতিতে ঝরে পরা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের জলধারার সমান। এর ফলে ৮৫ মিটার গভীর এবং ২ বর্গ কিমি জুড়ে একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়।
গ্রিনল্যান্ডের এই চাঁদোয়া আকৃতির বরফের স্তর আন্টার্কটিকার পর পৃথিবীর বিশাল বরফ স্তরগুলির মধ্যে একটি । এটি গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০% জায়গা ঢেকে রেখেছে। এটি সম্পূর্ণ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২৩ ফুট (৭ মিটার) পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই বরফ এখন আগের চেয়ে অনেক দ্রুতহারে গলছে, সরে যাচ্ছে এবং ভেঙে পড়ছে। নীচ থেকে উষ্ণ মহাসাগরের স্রোত ও ওপর থেকে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বরফ গলনের গতি বাড়াচ্ছে। খুব সম্ভব এই গলে যাওয়া বরফ সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। এই বৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই গত কয়েক দশকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
এই বিস্ফোরণের ফলে বরফাবৃত বিশাল এলাকা, যা আগে মসৃণ ছিল, এখন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দেখাচ্ছে। প্রায় ২৫ মিটার উঁচু বরফের চাঁই গুলো খাড়া দালানের মতো উপড়ে গেছে এবং প্রায় ৬ বর্গ কিমি এলাকা জলে টইটুম্বুর। এর পরিসর নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের দ্বিগুণ।
ল্যাঙ্কাস্টার ইউনিভার্সিটির গবেষক ডঃ জেড বোলিং বলেছেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম আমাদের উপাত্তে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট হয় যে বরফের নীচ থেকেই জল উঠে বিশাল বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।” এই ঘটনাটি শুধু একটি হিমবাহের নীচের হ্রদের বিস্ফোরণ নয়, এটি বরফের নীচে থাকা জলের গতিবিধি ও বরফ পাতের কাঠামো সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের পূর্ববর্তী ধারণাকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণত, বরফ গলে জল নীচে নামে, কিন্তু এই ঘটনা পুরো উল্টো – জল নীচ থেকে উপরের দিকে উঠে এসেছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, চাপে বরফের ভিত্ ফেটে যাওয়ার ফলে জল প্রবল বেগে উপরের দিকে উঠে এসেছে।
এই গবেষণার বিবরণ নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটি গ্রিনল্যান্ডের বরফের নীচে চাপা পড়া হ্রদগুলোর গতিবিধি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতাকে তুলে ধরেছে।
আরও স্পষ্টভাবে এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার জন্য গবেষকরা উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত উপাত্ত ব্যবহার করেন। এই বিরল দৃশ্য ধরা পড়ে সব উপগ্রহচিত্র একত্র করে বিশ্লেষণ করার পর।
এই ঘটনাটি বিজ্ঞানীদের জলবায়ু মডেলগুলোর সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। অনেক সময় মডেলের নির্ধারিত ঘটনার বাইরেও অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু ঘটে যায়, যেমন জলের এই ঊর্ধ্বগতি।
গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এমন বিস্ফোরণ বারবার ঘটলে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। বরফের নীচে জমে থাকা জল বাড়তে থাকলে, চাপও বাড়বে এবং আরও ফাটল তৈরি হবে।
এই ঘটনা স্পষ্টভাবে জানান দিল, গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তর গলনশীল হওয়ার পাশাপাশি, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিপজ্জনকভাবে ভেঙেও পড়ছে। বরফের দেশ গ্রিনল্যান্ড নীরবতা ভেঙে এক গোপন বিপদসংকেত পাঠিয়েছে পৃথিবীর কাছে- সময় ফুরিয়ে আসছে, এখনই জেগে না উঠলে মূল্য চুকাতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
সূত্র : Outburst of a subglacial flood from the surface of the Greenland Ice Sheet by Jade S. Bowling, et.al ; Nature Geoscience (30.7.2025).