ঘুমের বিবর্তন

ঘুমের বিবর্তন

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
সদস্য, সম্পাদকীয় বিভাগ, বিজ্ঞানভাষ
Posted on ১১ অক্টোবর, ২০২৫

এক অতি সাধারণ প্রাণী, মস্তিষ্ক নেই, অথচ ঘুমোতে পারে। নাম হাইড্রা। এই সত্য আমাদের ঘুমের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। কারণ, আমরা সাধারণত ঘুমকে মস্তিষ্কের কাজ হিসেবে দেখি। মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়, স্মৃতিগুলিকে সুশৃঙ্খল করে,আগামী দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। কিন্তু মস্তিষ্ক বিকাশের অনেক আগে থেকেই ঘুমের এই প্রাচীন সূত্র বিরাজমান। এমনই এক চমকপ্রদ প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই সরল জলজ প্রাণীটি। কেন মস্তিষ্কহীন প্রাণীরা ঘুমের ন্যায্য দাবি রাখে? নিঃসন্দেহে এটি আমাদের ঘুমের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরনো ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। হাইড্রার দেহের এক অংশে মুখ, অপর দিকে পা। চিমটের মতন করে এরা আটকে থাকে পাথর বা উদ্ভিদের গায়ে। স্নায়ুকোষের জাল ছড়ানো সারা শরীরে। কোনো কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক বা জটিল স্নায়ুতন্ত্র নেই। তবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা বলছে, এই মস্তিষ্কবিহীন প্রাণীটি নিয়মিত এক ‘বিশ্রাম দশায়’ চলে যায়। সেটি ঘুমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

 

১৯৭০-এর দশকে স্নায়ুবিজ্ঞানী আইরিন টবলর প্রস্তাব করেন শিকড়হীন একটি বর্ণনামূলক মানদন্ডের। সেটি ইলেকট্রো- এনসেফালোগ্রাম ছাড়াই প্রাণীদের ঘুম চিন্হিত করার উপায় করে দেয়। এক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট্যগুলি হলো,

ক. অচঞ্চলতা – বিশ্রামের সময় প্রাণীটি খুব কম নড়াচড়া করে।

 

খ.স্বাভাবিক বিশ্রাম থেকে দ্রুত জেগে গেলেও তাকে ঘুমের পর জাগাতে হয়।

 

গ. দেহভঙ্গির পরিবর্তন- বিশ্রাম দশায় মূলত দেহের ভঙ্গির পরিবর্তন হয়।

 

ঘ. জাগার পর স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারে।

 

ঙ.ঘুম পুনর্বাসন- যদি ঘুম বিঘ্নিত হয়, পরে অতিরিক্ত ঘুমের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন, হাইড্রা এই ধরণের বেশ কিছু মানদণ্ডে উতরে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঘুম বিঘ্নিত হলে পরবর্তীতে ঘুমের সময় বৃদ্ধির প্রবণতার ব্যাপারে। একটি নির্বাচিত পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হাইড্রা প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর একবার সক্রিয় এবং একবার বিশ্রাম দশায় যায়। অর্থাৎ ঘুম ও জাগরণ চক্র ২৪ ঘণ্টার দিনের মতো নয়, বরং এক দ্রুত চলমান ঘুম–জাগরণের পালাবদল।

গবেষকরা ভিডিও-ট্র্যাকিং পদ্ধতি এবং আলোর ঝলকানি প্রয়োগ করে তার ঘুম পরীক্ষা করে দেখতে চান, সে সেই সময় উত্তোলিত হয় কিনা। অর্থাৎ ঘুম থেকে তাকে জাগানো যায় কিনা! তাছাড়া, ঘুম বিঘ্নিত করার জন্য কম্পন এবং তাপমাত্রা পরিবর্তন করা হয়। তাতে পরের দিনে হাইড্রার ঘুমের সময় বৃদ্ধি পায়। তার কোষ বিভাজন কমে যায়। এ থেকে প্রমাণ হয়, ঘুম তার শারীরিক ও কোষ-স্তরের মেরামতের কাজগুলোর একটি অংশ হতে পারে।

 

এখানে আলোচ্য বিষয় হলো, হাইড্রা কীভাবে ঘুমের রাসায়নিকগুলোর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। গবেষকরা যেসব রাসায়নিক প্রয়োগ করেন, সেগুলি হল মেলাটনিন (মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ঘুমের সহায়ক হরমোন) এবং গাবা (এক ধরনের উদ্দীপনা নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক)। এগুলি হাইড্রার ঘুমের সময় ও ঘুমের প্রবণতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় ডোপামিন, যা বেশিরভাগ প্রাণীতে সজাগ দশা বাড়ায়, হাইড্রার ক্ষেত্রে তা কিন্তু উল্টোটা করে। এটি হাইড্রার ঘুমকে প্রণোদিত করে। অর্থাৎ, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই রাসায়নিকগুলোর ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে থাকতেই পারে! জিনের পর্যায়ে, ঘুম বিঘ্নিত হলে হাইড্রার প্রায় ২১২টি জিনের প্রকাশে পরিবর্তন দেখা যায়। এর মধ্যে বেশ কিছু জিন অন্যান্য প্রাণীদের ঘুম নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত । গবেষকরা ড্রোসোফিলা ফলমাছিকে সাধারণ ঘুম গবেষণার মডেল হিসাবে রাখেন। এরা এমন কিছু জিন পরিবর্তন করে যেগুলি হাইড্রার সঙ্গে বিবর্তনমূলক সম্পর্কযুক্ত। সেইসব পরিবর্তন ড্রোসোফিলার ঘুমের সময়কাল ও ঘুম-চক্রকে প্রভাবিত করে।

 

এ গবেষণার সবচেয়ে গভীর দিক হল, ঘুমের বিবর্তনের ইতিহাসে মস্তিষ্কের উদ্ভব। এটা হতেই পারে যে উন্নত মস্তিষ্ক পরবর্তীতে ঘুমের বিষয়গুলিকে আরও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এর আগে জেলিফিশ, মস্তিষ্কবিহীন জলজ প্রাণীর মধ্যেও ঘুমের মতো অবস্থা দেখা গিয়েছিল। সেটিও এই একই তত্ত্বকে সমর্থন করে – ঘুম একটি প্রাচীন, মৌলিক প্রাণীবৈশিষ্ট্য। এমনকি কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়েছেন, ঘুমের বিবর্তনে মস্তিষ্ক নয় পাচনপ্রক্রিয়াই হয়তো মূল চালিকা শক্তি। অর্থাৎ,শর্করা-উপযোগ, কোষ মেরামত, শক্তি পুনর্বিন্যাস ইত্যাদির জন্য ঘুম একটি ক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়। পরে মস্তিষ্কর উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। তথাপি অনেক প্রশ্নই রয়ে যায়। যেমন স্পঞ্জ বা প্লাকোজোয়া প্রজাতির কি ঘুমের মতো আচরণ আছে? ঘুম-নিয়ন্ত্রণের রাসায়নিক এবং জিনগত উপাদানগুলি বিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে? কিংবা মস্তিষ্কযুক্ত প্রাণীদের ঘুম ও এ ধরনের হোমিওস্ট্যাটিক নিয়ন্ত্রণ কীভাবে বিবর্তিত ও স্বতন্ত্র হয়েছে? এসব প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো ধাঁধা। তবে হাইড্রার মতো সরল প্রাণীরা এই অনুসন্ধানকে প্রণোদিত করতে পারে। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ঘুম গবেষণায় একটি দ্বার খুলে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের দেহগত, মস্তিষ্কগত ও জীববিজ্ঞানের গভীর ইতিহাস সম্পর্কে নিজেদের ধারণাকে ওলট পালট করে দিচ্ছে।

 

 

সূত্র : A sleep-like state in Hydra unravels conserved sleep mechanisms during the evolutionary development of the central nervous system by

Hiroyuki J. Kanaya, et.al ; Science Advances (7 Oct 2020 Vol 6, Issue 41).

2 thoughts on “ঘুমের বিবর্তন

  1. Abhijit Kar Gupta

    খুব সুন্দর সহজ করে বুঝিয়ে লেখা!! এইরকম একটা বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। অনেক কিছু জানলাম। লেখক কে অনেক ধন্যবাদ।

    1. Suparna Chatterjee

      ধন্যবাদ স্যার🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 + seven =