পাঠ্যবইতে লেখা থাকত আমাদের চোখ নাকি জীবাণুমুক্ত। কারণ, চোখের জলে লাইসোজাইম উৎসেচক থাকে। এই উৎসেচকটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে চোখকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে। আজ বিজ্ঞানীরা জানেন, চোখের উপরিভাগেও বাস করে অণুজীবের এক ক্ষুদ্র সমাজ—অকুলার মাইক্রোবায়োম। সংখ্যায় কম হলেও এই অণুজীবগুলো চোখের স্বাস্থ্যে বড় ভূমিকা পালন করে। কখনো তারা চোখকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, আবার কখনো ভারসাম্য নষ্ট হলে নিজেরাই রোগের উৎস হয়ে ওঠে।
এই গবেষণার মোড় ঘোরে এক অপ্রত্যাশিত ল্যাব–দুর্ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুলার ইমিউনোলজিস্ট অ্যান্টনি সেন্ট লেগারের দল চোখের ব্যাকটেরিয়া চাষ করতে হিমশিম খাচ্ছিল। হঠাৎ ভুলবশত ল্যাবে একটি প্লেট এক সপ্তাহ থাকার পর দেখা গেল , সেখানে চুপিসারে বেড়ে উঠেছে ধীর-গতি এক ব্যাকটেরিয়া: কোরিনিব্যাক্টেরিয়াম ম্যাস্টিটিডিস। অসাবধানতাই হয়ে উঠল আবিষ্কারের চাবিকাঠি !
চোখের পৃষ্ঠ বিশেষত কনজাংটিভা ও কর্নিয়া হল এদের মূল বসতি। এখানে মানুষের প্রতি ১০০ কোষে মাত্র ছ’টি ব্যাকটেরিয়া মিললেও এই ক্ষুদ্র সমাজের গতিবিধি অত্যন্ত কৌশলী। স্ট্যাফিলোকক্কাস, স্ট্রেপ্টোকক্কাস, প্রোপিওনিব্যাক্টেরিয়াম, কোরিনেব্যাক্টেরিয়াম, ল্যাক্টোব্যাসিলাস —এরা সাধারণত চোখের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। কিন্তু ভারসাম্য বদলালে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে। দেখা দিতে পারে গ্লকোমা, ব্লেফারাইটিস, কনজাংটিভাইটিস কিংবা কর্নিয়ার সংক্রমণ।
গ্লকোমা রোগীদের চোখে অতিরিক্ত সিউডোমোনাস এবং অ্যাসিনেটোব্যাক্টরের উপস্থিতি চোখের প্রদাহ বাড়িয়ে চোখের স্নায়ুর ক্ষতি ত্বরান্বিত করতে পারে। এমনকি ভাইরাসজনিত কনজাংটিভাইটিসেও নতুন তথ্য উঠে আসছে। অ্যালেন ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা দেখেছেন, রোগীর কর্নিয়ায় স্থায়ী দাগ পড়বে কি না—তা নির্ভর করে সংক্রমণ ঘটানো ভাইরাসের জিনগত বৈচিত্র্যের ওপর। অর্থাৎ, সংক্রমণের রূপই নির্ধারণ করতে পারে দৃষ্টিশক্তির ভবিষ্যৎ ।
চোখের স্বাস্থ্যের সঙ্গে দেহের অন্যান্য অঙ্গের মাইক্রোবায়োমের সম্পর্কও এখন পরিষ্কার হচ্ছে। সোগ্রেন সিনড্রোমে আক্রান্তদের অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার গঠন বদলে যায়, যা চোখে চরম শুষ্কতা তৈরি করতে পারে। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ত্রের জীবাণু সমষ্টির অস্বাভাবিকতা কর্নিয়ার ক্ষতি বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অস্থির করে তোলে।
একইভাবে “অন্ত্র-চক্ষু সংযোগ “- এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে অন্ত্রের বাধা দুর্বল হলে ব্যাকটেরিয়ার উপাদান রক্তের মাধ্যমে চোখের রেটিনা ও স্নায়ুতে প্রদাহের বীজ বপন করতে পারে। বার্ধক্যজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন কিংবা আইবিডি–র রোগীদের ক্ষেত্রেও এই যোগসূত্রের চিহ্ন মিলছে।
ভবিষ্যৎ চিকিৎসা তাই এক নতুন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা চোখের নিজস্ব ‘প্রোবায়োটিক’ তৈরি করতে চান। সেন্ট লেজারের দল ইতিমধ্যেই সি. ম্যাস্টিটিডিস ব্যাকটেরিয়ার জিন বদলে প্রদাহ কমানোর অণু উৎপাদনে সফল হয়েছে। অন্যদিকে, উপকারী ল্যাক্টোব্যাসিলাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া বা অন্ত্রের জীবাণু সমষ্টি থেকে তৈরি বুটিরেট জাতীয় অণু চোখের শুষ্কতা কমাতে কতটা কার্যকর হতে পারে, তা নিয়েও জোর গবেষণা চলছে।
সব মিলিয়ে, চোখের জীবাণু সমষ্টি ছোট হলেও তার ভূমিকা বিশাল। বিজ্ঞানীরা এখন এই অদৃশ্য সহচরদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চোখের রোগ প্রতিরোধ তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সম্পূর্ন নতুন পথের দিশা দেখাতে চাইছেন ।
সূত্র : The ocular microbiome: more than meets the eye Bacteria, viruses and fungi that colonize the body — including some that live directly on eye surfaces — can have an important role in eye health By Roxanne Khamsi. This article is part of Nature Outlook: The human microbiome, 25th November,2025.
