চাঁদের গভীরতম ক্ষত

চাঁদের গভীরতম ক্ষত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বুকে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি বছরের পুরনো এক মহাজাগতিক রহস্য। নতুন এক গবেষণা বলছে, চাঁদের গভীরতম ও প্রাচীনতম গহ্বর,যার নাম ‘সাউথ পোল–অ্যাটকেন বেসিন’, সেটি এখনও তার অন্তর্গত আগ্নেয় জন্মের আলোকচিহ্ন ধরে রেখেছে। এই বিশাল গহ্বরটি চাঁদের ইতিহাসে এক ভয়ংকর অধ্যায়। প্রায় ৪৩০ কোটি বছর আগে, এক বিশাল আকারের গ্রহাণু উত্তর থেকে প্রচণ্ড বেগে এসে আঘাত হানে চাঁদের পৃষ্ঠে। সেই আঘাতেই তৈরি হয় এই ২৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ৮ কিলোমিটার গভীর বেসিন। এটি আজও সৌরজগতের বৃহত্তম গহ্বরগুলির মধ্যে অন্যতম। নাসার লুনার রিকনেসান্স অরবিটার এবং অন্যান্য চন্দ্র অভিযানের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহবিজ্ঞানী, জেফ্রি অ্যান্ড্রুজ-হ্যান্না ও তাঁর দল জানিয়েছেন,আঘাতটি একদম সোজা আঘাত ছিল না। বরং এটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে কৌণিকভাবে আছড়ে পড়ে। যেন কোনো পাথর জলস্রোতে তির্যকভাবে পড়ে তরঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে। গহ্বরটির উত্তর দিক তুলনামূলকভাবে সমতল, আর দক্ষিণ দিক উঁচু ও ঘন। কারণ, আঘাতের পর যে বিপুল পরিমাণ গলিত পদার্থ ছিটকে বেরিয়েছিল, তা দক্ষিণ দিকে গিয়ে জমাট বাঁধে। এই গঠন থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, গর্তটি একপাশ থেকে আঘাতপ্রাপ্ত, অর্থাৎ একদিকের ‘ডাউন–রেঞ্জ’ এলাকায় বেশি চাপ ও তাপ তৈরি হয়েছিল। চাঁদের জন্মের প্রথম যুগে তার পৃষ্ঠ জুড়ে ছিল এক গভীর গলিত শিলার সমুদ্র – ম্যাগমা ওশান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই তরল পদার্থ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়। ভারী উপাদানগুলো নীচে থিতিয়ে ম্যান্টেলে জমা হয়, আর হালকা উপাদানগুলো ত্বকে উঠে আসে। কিন্তু কিছু উপাদান যেমন, পটাশিয়াম (K), বিরল ভূ- মৌল (Rare Earth Elements), এবং ফসফরাস (P) এই দুই স্তরের মাঝখানে আটকে যায়। এদেরই বিজ্ঞানীরা একত্রে বলেন ‘ক্রীপ’। ক্রীপ পদার্থ চাঁদের পৃথিবীমুখী অংশে বেশি পাওয়া যায়। কারণ, সেখানেই আগ্নেয় কার্যকলাপ বেশি হয়েছিল। প্রাচীন লাভা শক্ত হয়ে তৈরি করে ‘মারিয়া’ বা চাঁদের অন্ধকার সমভূমি। কিন্তু কেন এই ক্রীপ উপাদান শুধু এক দিকেই বেশি, সেটিই ছিল দীর্ঘদিনের প্রশ্ন। অ্যান্ড্রুজ-হ্যান্নার ও তার দল মনে করেন, এই অসম বণ্টনের কারণ সাউথ পোল-অ্যাটকেন বেসিনের ওই আঘাত। সেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ চাঁদের গভীর অভ্যন্তরে গলিত পদার্থকে একপাশে ঠেলে দেয় – যেমন টুথপেস্ট টিউব চেপে ধরলে একপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে।ফলে ক্রীপ উপাদান প্রধানত পশ্চিম দিকে জমে, আর পূর্ব দিকে তুলনামূলকভাবে কম থেকে যায়। চাঁদের পশ্চিমের বেসিনে থোরিয়ামের উচ্চ ঘনত্ব সেই ক্রীপ অঞ্চলেরই নির্দেশক। থোরিয়াম হল এক ধরনের তেজস্ক্রিয় উপাদান যা গলিত শিলার সঙ্গে উঠে আসে। গবেষকরা বলছেন, এর উপস্থিতি প্রমাণ করছে যে সেই প্রাচীন আঘাত চাঁদের ত্বকের গভীর স্তর ভেদ করে উপরের দিকে ম্যাগমা তুলেছিল। আগামী আর্টেমিস মিশনে যখন নভোচারীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণ করবেন, তখন এই বেসিন থেকে সংগৃহীত শিলাখণ্ডই চাঁদের আগ্নেয় ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভুল সূত্র দিতে পারে। বিজ্ঞানীদের আশা , সেই নমুনা বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে, কবে চাঁদ সম্পূর্ণরূপে কঠিন হলো, তার গভীরে কী কী উপাদান আজও সক্রিয়, এবং কীভাবে আগ্নেয় জন্মের যুগ থেকে সে আজকের প্রশান্ত, ধূসর উপগ্রহে পরিণত হলো।

 

সূত্র: “Southward impact excavated magma ocean at the lunar South Pole–Aitken basin” by Jeffrey C. Andrews-Hanna, William F. Bottke, et.el ; 8 October 2025, Nature.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 2 =