চাঁদের জন্মকথা: থিয়ার ধাক্কা

চাঁদের জন্মকথা: থিয়ার ধাক্কা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ ডিসেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর আকাশে আজ যে চাঁদকে আমরা দেখি, তার জন্ম হয়েছিল এক মহাজাগতিক সংঘর্ষে। ‘থিয়া’ নামক যে গ্রহটি পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চাঁদ তৈরি করে, সে ঠিক কোথা থেকে এসেছিল? ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সৌরজগৎ গবেষণা ইনস্টিটিউট–এর গবেষকদের সর্বশেষ বিশ্লেষণ বলছে, থিয়া এসেছে সৌরজগতের ভিতর থেকেই। এই বিশ্লেষণ, প্রচলিত ধারণার ঠিক উল্টো। গবেষণা দলটি পৃথিবী, চাঁদ এবং উল্কাপিণ্ড- এই তিন উৎসের পাথরে থাকা আইসোটোপ বিশ্লেষণ করেছেন। এগুলি মূলত একই মৌলের ভিন্ন নিউট্রন-ধারী সংস্করণ। গবেষণা প্রধান টিমো হপ বলছেন, “আইসোটোপ হলো গ্রহের বংশলতিকা। যেখানেই জন্ম হোক, রাসায়নিক স্বাক্ষর তা ঠিক বলে দেয়।” আগের বহু গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাপোলো মিশনের চাঁদের নমুনা ও পৃথিবীর নমুনার আইসোটোপিক গঠন প্রায় হুবহু মিলছে। এই মিলই বিজ্ঞানীদের মনে সন্দেহ তৈরি করেছিল, কেন দুটি আলাদা দেহের উপাদান এত একরকম? গবেষকরা এবার পৃথিবীর ১৫টি শিলা ও চাঁদের ৬টি নমুনায় লোহা-র আইসোটোপ মেপেছেন অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে, যা আগের গবেষণাকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা দেখেন, লোহা, মলিবডেনাম ও জিরকোনিয়ামের (যারা গ্রহের কোর, ম্যান্টল ও পরবর্তী সংঘর্ষের আলাদা ইতিহাস বহন করে) সমন্বিত তথ্য একটাই দিকে ইঙ্গিত করছে – পৃথিবী ও থিয়া দু’জনেরই জন্ম সৌরজগতের ভিতরের অঞ্চলে, খুব কাছাকাছি কক্ষপথে। হপের ভাষায়,“পৃথিবী আর থিয়া সম্ভবত প্রতিবেশী ছিল।”

পৃথিবীতে আছড়ে পড়া বিভিন্ন উল্কাপিণ্ডকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আগেই তাদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন।
ক. অভ্যন্তরীণ সৌরজগৎ থেকে উৎপন্ন এবং
খ. বহিঃসৌরজগত থেকে উৎপন্ন।
এই বিভাজনের নেপথ্যে রয়েছে বৃহস্পতির মহাকর্ষ – যাএকসময় ভেতরের ও বাইরের উপাদানগুলির মিশ্রণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। নতুন গবেষণা সেই বৃহত্তর মানচিত্র ব্যবহার করে দেখিয়েছে, থিয়া পরিষ্কারভাবেই অভ্যন্তরীণ সৌরজগৎ দলের সদস্য। থিয়ার রাসায়নিক স্বাক্ষর, কোনো পরিচিত উল্কাপিণ্ডের সাথেই মেলে না। এর মানে, হয়তো থিয়ার মতো ঐ অঞ্চলের পাথর এখনও পৃথিবীতে আছড়ে পড়েনি। এই ফলাফল খোদ পৃথিবীর গঠনের গল্পকেও বদলে দেয়। পৃথিবীর ম্যান্টলে থাকা কিছু লোহা ও মলিবডেনাম হয়তো গ্রহ-গঠনের সময়কার নয়। তারা হয়তো থিয়ার সংঘর্ষেই এসেছে। একই কক্ষপথে ঘোরাফেরা করা মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে উপাদান বিনিময় সাধারণ ব্যাপার ছিল, যা গ্রহ-সীমার ধারণাকেও আরও অস্পষ্ট করে। একটি বিলীন হয়ে যাওয়া গ্রহও তার পরিচয় রেখে যায়। বিশ্বের অনেক গবেষকই এখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মঙ্গল, বুধ, বড় গ্রহাণুর জন্মকাহিনী নতুন করে লেখার চেষ্টা শুরু করেছেন। তবে আরও উল্কাপিণ্ড ও নতুন চন্দ্রনমুনা সংগ্রহ হলেই হয়ত সৌরজগতের আইসোটোপিক মানচিত্রকে পরিপূর্ণ করা যাবে।

সূত্র: The Moon-forming impactor Theia originated from the inner Solar System by
Timo Hop; Science; 20th Nov, 2025;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 1 =