
১০-এর ঘাত হিসেবে সংখ্যা লেখার রেওয়াজ চীনে ভারতরই মতো অতি প্রাচীন। ১০-ভিত্তিক স্থানাঙ্ক-মূল্যের একটি বিশেষ প্রয়োগ চীনে খ্রিস্টাব্দের প্রথম সহস্রাব্দের চারশো বছর আগে দৈনন্দিন ব্যবহারের অঙ্গ ছিল। তাতে সংখ্যার অবস্থানই তার মূল্য নির্ধারণ করে দিত, সঙ্গে থাকত একটি ফাঁকা পরিসর যা কোনো সংখ্যার অনস্তিত্ব বোঝাত।
লিখিত সংখ্যার ভাবলিপির পাশাপাশি চৈনিকদের ছিল নিজস্ব এক “ঘুটি কৃষ্টি”, যার শিকড় পোঁতা ছিল কেজো ব্যবহারে। তাদের “ঘুটি” ছিল গণনকাঠি। ঘুটির মতো সেই কাঠিগুলিকে একটা চ্যাপটা তলের ওপর দিয়ে এদিক ওদিক সরানো হত। সেই তলে পরের পর দাগ কাটা থাকত ১০-এর বিভিন্ন ঘাতের। এই ঘুটি বা কাঠিগুলো ছিল যাবতীয় মৌলিক পাটীগণিতের গণনার হাতিয়ার। পরে এগুলিকে বীজগাণিতিক সমীকরণ সমাধান করার কাজেও লাগানো হত। চৈনিকরা যদি কাঠি-সংখ্যা আর তার সাহায্যে কৃত গাণিতিক ক্রিয়াগুলো লিখে ফেলত তাহলে যা পাওয়া যেত তা আমদের আজকের দিনের সংখ্যাপাতন আর গুণ, ভাগ, বর্গমূল বার করা প্রভৃতি গাণিতিক ক্রিয়াগুলিরই সমতুল্য হত।
একেবারে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪০০ থেকে এই ঘুটি/কাঠিগুলো ব্যবহৃত হত। পুরাতত্ত্ববিদরা প্রাচীনতম যে-কাঠিগুলো মাটি খুঁড়ে বার করেছেন সেগুলো খ্রিপূ ১৭০ অব্দের। সুদূর খ্রিপূ ২০২ অব্দের খতিয়ান থেকে বর্ণনা পাওয়া গেছে যে হান বংশের প্রথম সম্রাট জাঁক করে বলছেন, তিনিই একমাত্র জানেন, “তাঁবুতে বসে গণনকাঠি দিয়ে কী করে সমরাভিযানের পরিকল্পনা ছকতে হয়”। এই ছোটো ছোটো কাঠিগুলো ছিল সাধারণত বাঁশের তৈরি, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৪ সেমি। তবে কখনো কখনো কাঠ, হাড়, শিং, এমনকী হাতির দাঁত কিংবা জেড পাথর দিয়েও তৈরি হত (বলা বাহুল্য, সেগুলো বড়োলোকদের ব্যবহারের জন্য) । এগুলোকে (মোট ২৭১টা) একটা ছোটো ষড়ভুজ আকৃতির থলিতে রাখা হত, অনেকটা আজকের দিনের ইলেকট্রনিক গণক কিংবা স্মার্ট ফোনের খাপের মতো। খ্রিস্টাব্দের ঠিক আগের কয়েক শতকের পুরোনো শবদেহের কঙ্কালের পাশে রাখা এইরকম গণনকাঠির গুচ্ছ পাওয়া গেছে ।
কারা ব্যবহার করত এগুলো? বলতে গেলে সবাই। বণিক, ভ্রমণকারী, সন্ন্যাসী, সরকারি কর্মকর্তা, গণিতবিদ আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। যখন যেখানে কোনো গণনকার্য প্রয়োজন হত, তখনি, সেখানেই এই গণনকাঠিগুলোকে থলি থেকে বার করে একটা চাদর, টেবিল, মেঝে কিংবা একটা চ্যাপটা তলের ওপর বিছিয়ে নেওয়া হত। থাং বংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রি) বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা যেখানেই যেতেন, গণনকাঠি-ভর্তি থলি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। কাঠিগুলোর সাহায্যে যে-হিসেব করা হত সেগুলোকে প্রথমে লিখে ফেলা হত বাঁশের পাতায়, কাগজ উদ্ভাবনের পর খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে কাগজের ওপর। ধরে নেওয়া হত কাঠি দিয়ে গণনা করা এমনই প্রাথমিক একটা পটুতা যে সকলেরই তা জানা। তাই প্রথম দিককার গণিতের বইগুলোতে এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা থাকত না। তবে সুন-জি নামক এক শিক্ষকের লেখা বলে বর্ণিত চতুর্থ শতকের একটি বইতে (‘শিক্ষক সুন-রচিত চিরায়ত গণিত গ্রন্থ’) বর্ণনা করা হয়েছে কী করে ওই কাঠিগুলোর সাহায্যে গণনা করতে হয়। পরে থাং রাজত্বকালে যে-দশটি চিরায়ত গণিত-গ্রন্থর সমাহার প্রকাশিত হয় এটি তার অন্তর্ভুক্ত। প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রার্থীদের এ বইটি পড়ে পাশ করে সরকারি কৃত্যকে চাকরি পেতে হত। খ্রিস্টাব্দের প্রথম কয়েক শতকে এই গণনকাঠির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেইসব দেশে যেগুলি একই সঙ্গে ৎ ভারত আর চীনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
কীভাবে কাজে লাগানো হত কাঠিগুলোকে? পদ্ধতিটা একই সঙ্গে সরল অথচ সুকৌশলী। ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যগুলোকে সাজিয়ে নেওয়া হত কাঠিগুলো দিয়ে। তার দুটো ছাঁদ, একটা অনুভূমিক (‘হেং’), অন্যটা লম্বালম্বি (‘জং’)। ১০-এর চেয়ে বড়ো সংখ্যা লিখতে হলে কাঠিগুলোকে স্তম্ভর আকারে সাজিয়ে নেওয়া হত। একেবারে ডানদিকের স্তম্ভটা এককের ঘর, তার আগেরটা দশকের ঘর, তার আগেরটা শতকের … এইভাবে। একটা স্তম্ভ ফাঁকা রাখা হত, তার মানে সেখানে কোনো কাঠি থাকবে না, অর্থাৎ আজ আমরা যাকে বলি শূন্য। চৈনিকরা ওই ফাঁকা ঘরটাকে বলতেন ‘কং’, হিন্দুরা সংস্কৃতে যাকে বলতেন ‘শূন্য”। স্তম্ভগুলোকে পড়বার সুবিধার জন্য কাঠিগুলোর অনুভূমিক আর লম্বালম্বি ছাঁদগুলোকে একান্তরভাবে (একটা করে খোপ বাদ দিয়ে) বসিয়ে নেওয়া হত। লম্বালম্বি ছাঁদগুলোকে বসানো হত এককের ঘরে, তারপর শতকের ঘরে, তারপর দশ সহস্রর ঘরে, এইভাবে। আর অনুভূমিক ছাঁদগুলোকে বসানো হত দশকের ঘরে, তারপর সহস্রের ঘরে, তারপর লক্ষের ঘরে … এইভাবে।
স্তম্ভগুলোকে দুপাশেই বাড়িয়ে নেওয়া যেত। এককের ঘরের ডান পাশের স্তম্ভগুলোয় থাকত ঋণাত্মক সংখ্যা, সেগুলোকে বিভিন্ন রং দিয়ে চিহ্ণিত করা হত। কাঠিগুলোর সাহায্যে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করা হত। তার নিয়মকানুনগুলো সুন জি-র বইতে ব্যাখ্যা করা আছে। ল্যাম লাই ইয়ং-এর ফ্লিটিং ফুটস্টেপ্স (চপল চরণপাত) বইতে তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। বাস্তবিক, ল্যাম লাই ইয়ং যখন তাঁর বিশিষ্ট কর্মজীবনের জন্য কেনেথ মে পদক পান, তখন তিনি শ্রোতাদের সামনে ধাপে ধাপে গুণ আর ভাগ করে দেখিয়েছিলেন। তিনি দেখান, নবম শতকের প্রসিদ্ধ মুসলিম গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-খোয়ারিজমির ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলি সুন জি-র চিরায়ত পদ্ধতিগুলির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। চৈনিক গণন-কাঠির সংখ্যাপতন আর আধুনিক “হিন্দু-আরবি” সংখ্যাপাতনের সাদৃশ্যগুলি আমাদের মনে আগ্রহ জাগায় । দেখতে অবশ্য এরা একেবারেই অন্যরকম, কিন্তু চেহারা অনেকসময়েই বিভ্রান্তিকর।
উৎস: Meera Nanda, Science in Saffron, Three Essays Collective, Gurgaon, 2016. অনুবাদ: আশীষ লাহিড়ী।