
ঘরের কোণে টোস্টার থেকে ম ম করছে গন্ধ। সামনে কেউ হাতে তুলে নিচ্ছে, ছুরি আর ফলার গোড়ায় মাখন । কিছু না ভেবেই ধরে নেওয়া গেল পরবর্তী দৃশ্যটা কী হতে চলেছে। এবার পাউরুটি টুকরোতে মাখন পড়বে। তাই তো? ঠিক এই আগামের বোধ বা ভবিষ্যৎ অনুমানই হল মস্তিষ্কের গোপন দক্ষতা, যা আমাদের বাস্তবজগৎকে জোড়া লাগিয়ে রাখে সিনেমার মত। এই চমৎকার মানসিক বুননের পেছনে আছে মস্তিষ্কের ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক নামক অংশ। যখন আমরা কাউকে কিছু ধরতে, তৈরি করতে বা ব্যবহার করতে দেখি তখনই এগুলি সচল হয়ে ওঠে। নেদারল্যান্ডস ইন্সটিটিউট ফর নিউরোসায়েন্সের গবেষক ক্রিস্টিয়ান কিসার এবং ভ্যালেরিয়া গাজোলা একটি নাটকীয় প্রশ্ন তুলেছেন: “যদি আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ জেনেই যাই, তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের নালিপথও কি পাল্টে যায়?” তাঁরা তৈরি করলেন দুই ধরনের দৃশ্য: একটিতে টোস্ট বানানোর স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা, অন্যটিতে সেই একই দৃশ্য অগোছালোভাবে কাটাকাটি করে সাজানো। কিছু স্বেচ্ছাসেবকের মস্তিস্কে ইতিমধ্যেই চিকিৎসাগত প্রয়োজনে তড়িৎদ্বার বসানো ছিল। ফলে তারা এই দৃশ্য দেখে মিলিসেকেন্ড সূক্ষ্মতাতেও কি ভাবছেন অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্কের ভিতরের গতি, রেকর্ড করা গেল। দেখা গেলো, যখন কাজগুলি সঠিক ক্রমে চলছিল, তখন প্রিমোটর কর্টেক্স (যা আমাদের নড়াচড়ার প্রস্তুতি নেয়) আগে থেকেই সক্রিয় হয়ে পড়ছে এবং তারপর সেই সংকেত নীচে দৃষ্টি সংক্রান্ত কোর্টেক্সে যাচ্ছে। যেন মস্তিষ্ক বলছে, “আর চোখে দেখার দরকার নেই, আমি আগেই জানি, কী হবে!” কিন্তু যখন টুকরো গুলি এলোমেলো, তখন দৃষ্টি সংক্রান্ত কোর্টেক্সকে পুরো কাজটাই করতে হয়- চিরাচরিত রাস্তা ধরেই। গাজোলা বলেন, “ওরা চোখ দিয়ে দেখেনি, ওরা একজন অন্য ব্যক্তি হিসাবে পর্দায় নিজেকেই দেখেছে- নিজেরা কী করে!” অর্থাৎ, পূর্ব অভ্যাস আর শরীরের স্মৃতি দিয়েই মস্তিষ্ক অনুমান করে নেয় পরবর্তী দৃশ্যটিকে। এই গবেষণা প্রমাণ করে, ‘পূর্বাভাস মূলক বুদ্ধিমত্তা’ শুধু হাই-টেক কম্পিউটিং তত্ত্ব নয়, আমাদের প্রতিদিনের কথোপকথন, রান্না বান্না আরও অনেক কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে। এই মডেল অনুযায়ী, মস্তিষ্ক আগাম একটি চিত্র তৈরি করে রাখে। বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেলে, সেটাই চুড়ান্ত। না মিললে, ‘ভুলের সংকেত ’ ! পরে আবার চকিতে ঠিক করে নেয়। স্ট্রোকে আক্রান্তদের পুনর্বাসনে এই মডেল কাজে লাগতে পারে। শুধু নকল নয়, ‘আগাম কল্পনার অনুশীলন’ করে চলতে হবে। রোবটিক সহকারীদের ক্ষেত্রে, যদি তারা এক সেকেন্ড আগেই বুঝতে পারে মানুষের উদ্দেশ্য, তাহলে সময়মতো হাত বাড়াবে, এড়াবে দুর্ঘটনা। এই গবেষণা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা যা দেখি, তার অনেকটাই আসলে চোখের আগেই দেখে ফেলে আমাদের মস্তিষ্ক। স্মৃতি, অভ্যাস, গতি- ছন্দ, এসবই গোপনে আমাদের দেখার জগতকে আগেভাগেই সাজিয়ে দেয়।