
ছত্রাক শব্দটির সাথে আমরা কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। হয়তো কখনো সুস্থ হতে পেনিসিলিন খেয়েছি বা সুস্বাদু পদ হিসেবে মাশরুম খেয়েছি।যেভাবেই হোক এর ভালো বা খারাপ প্রভাবে আমরা অভ্যস্ত। মাইকোলজি হল বিজ্ঞানে ছত্রাক নিয়ে অধ্যয়নের শাখা। আর যারা ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা হলেন মাইকোবায়োলজিস্ট।আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাইকোলজি খুব জনপ্রিয় গবেষণার ক্ষেত্র নয়। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় মাইকোলজির উপর বিশেষ কোর্স বা প্রোগ্রাম অফার করে না। এই প্রবণতা বদলানোর কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। অথচ
ছত্রাকজনিত রোগ বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করে। এগুলো বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস করে দেয়। তাহলে কেন আরও মাইকোলজিস্ট এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন না? অন্যদিকে, মানুষের জীবনযাত্রায় ছত্রাকের উপকারিতাও অনেক। ছত্রাকের বেশ কিছু প্রজাতি আমাদের খাদ্য ও ওষুধের উৎস হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ছত্রাকরা হল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাণীজগৎ।বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই মাইকোলজিকে অনুজীববিদ্যার একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করেন।
ছত্রাকরা বিভিন্ন আকার আকৃতির হয়। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ৭০,০০০-এর বেশি ছত্রাকের প্রজাতি চিহ্নিত করেছেন। তবে গবেষকদের ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা এর ২০ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এর মানে, পৃথিবীতে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ছত্রাক প্রজাতি থাকতে পারে। যেখানে, তুলনামূলকভাবে, মাত্র সাড়ে তুন লক্ষ নামযুক্ত ফুলগাছের প্রজাতি রয়েছে।
ছত্রাকের জগতটি বিশাল এবং আমরা এর সম্পর্কে খুব কমই জানি। ছত্রাক সম্পর্কিত কয়েকটি খুব প্রাথমিক বিষয়ের কথা বলা যাক। মাইসেলিয়াম হল ছত্রাকের উদ্ভিজ্জ অংশ যা গাছের শিকড়ের মতো মাটির নীচে অদৃশ্যভাবে ছড়িয়ে থাকে। আমরা সাধারণত ভেজা কাঠের পাটাতনে বা মাটিতে সাদা জালযুক্ত যে পদার্থ দেখতে পাই সেটিই হল মাইসেলিয়াম। আর মাশরুম হল ছত্রাকের প্রজনন কাঠামো। এটি মাইসেলিয়ামের ফলন্ত অংশ, যা ছত্রাকের প্রজনন কাঠামো হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ছত্রাককে একটি পিচ গাছের সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে মাইসেলিয়াম হল গাছের শিকড় ও কাঠ , আর মাশরুম হবে ফুল ও ফল।
মাইকোরাইজাল সম্পর্ক হল এক বিশেষ ধরনের মাইসেলিয়া্ম, যা উদ্ভিদের সাথে মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে তোলে, পুষ্টি গ্রহণে সাহায্য করে, এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মানুষের সাথে ছত্রাকের সম্পর্ক কৃষির চেয়েও অনেক পুরনো। প্রাচীন মানুষের দাঁতের ওপর জমে থাকা আঠালো আস্তরণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে ইউরোপের শিকারি মানবগোষ্ঠী প্রায় ১৮,০০০ বছর আগে থেকেই মাশরুম খেতেন । সেই সময় থেকে, মানবপ্রজাতি এই প্রাণিজগতকে বহু কাজে ব্যবহার করে আসছে।
উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে, মাইকোলজিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকা এবং ব্রিটিশ মাইকোলজিক্যাল সোসাইটি মাইকোলজিস্টদের একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে সংগঠিত করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে নর্থ আমেরিকান মাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল মাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউরোফু প্রভৃতি সংস্থা মাইকোলজিক্যাল সম্প্রদায়কে আরও শক্তিশালী করেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশের মাধ্যমে এই সংস্থাগুলি বিশ্বব্যাপী মাইকোলজির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
তবে হতাশজনক হলেও সত্যি যে বিশ্বব্যাপী ছত্রাক এখনো পর্যাপ্ত গবেষণার আওতায় আসেনি। এর কারণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রথমত, ছত্রাক গবেষণা করা সহজ নয়। বেশিরভাগ ছত্রাকের প্রজাতি ল্যাবরেটরিতে চাষ করা সম্ভব নয়। প্রকৃতিতে ছত্রাকের ফলনের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। মাশরুম ছাড়া, মাইসেলিয়াম খুঁজে বের করাও অত্যন্ত কঠিন । মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই মাইকোলজির ওপর বিশেষ পাঠ্য ক্রম বা কর্মসূচি রয়েছে। আগেকার দিনে ছত্রাক বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন ছত্রাকবিদ্যা সাধারণত উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ(বটানি) এর অন্তর্ভুক্ত,কিন্তু মজার বিষয় হল ছত্রাক আসলে উদ্ভিদের চেয়ে প্রাণীদের সাথেই বেশি সম্পর্কিত। তবে এখন বটানি বিভাগগুলি সংকুচিত হয়ে আসছে, ফলে তারা মাইকোলজিস্টদের খুব একটা সমর্থন দিচ্ছে না। এর ফলে, এই বিভাগহারা মাইকোলজিস্টদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভেতর টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যদিও গত দশকে অপেশাদার মাশরুম সংগ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে, তবে ছত্রাক সংক্রান্ত গবেষণায় আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়েনি। কিছু মাইকোলজিস্ট মনে করেন, তাদের বৈজ্ঞানিক শাখায় সমন্বয়, সহযোগিতা এবং বিশেষায়নের অভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইকোলজির জন্য অর্থ বরাদ্দ কম হওয়ার জন্য দায়ী ।
সমস্ত ছত্রাকের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট বর্তমান।শ্রেণিবিন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ছত্রাককে কোন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেই নিয়ে সর্বদাই বিতর্ক চলে। প্রাথমিকভাবে বলা যায়,ছত্রাকের ইউক্যারিওটিক কোষ থাকে, যার অর্থ তাদের কোষের কেন্দ্রে একটি নিউক্লিয়াস থাকে। এটি তাদের প্রোক্যারিওটিক ব্যাকটেরিয়া থেকে পৃথক করে। ছত্রাক বহুকোষীয়ও হয়, যা তাদের এককোষী ইউক্যারিওটিক ব্যাকটেরিয়া থেকে আলাদা করে। পশু আর উদ্ভিদও ইউক্যারিওটিক কোষযুক্ত প্রাণিগোষ্ঠী, কিন্তু ছত্রাক পশুদের তুলনায় আলাদা। তার কারণ হলো এরা চলাফেরা করতে পারে না এবং যৌন প্রজননের পরিবর্তে স্পোর বা রেণুর সাহায্যে বংশবিস্তার করে । আবার এরা উদ্ভিদের তুলনায় আলাদা কারণ তারা সালোকসংশ্লেষের মতো নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না বরং পচা-গলা জীবদেহ থেকে পুষ্টিরস শোষণ করে বেঁচে থাকে যা পচন নামে পরিচিত। ছত্রাক নিয়ে আলোচনায় লাইকেন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। লাইকেন হল ছত্রাক ও শৈবালের সহবস্থানমূলক সম্পর্ক, সচরাচর দেখাও যায় না। লাইকেন প্রকৃতিতে কোথায় মানানসই তা কেউ জানে না। সবচেয়ে বড় ছত্রাক গোষ্ঠী হলো আসকোমাইসেটিস (Ascomycetes)। সর্বাধিক সংখ্যক ছত্রাক প্রজাতি এর অন্তর্ভুক্ত।
ছত্রাকবিদ্যার ক্ষেত্রটি বহুমুখী। জীবপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে আসক্তি নিরাময় পর্যন্ত ছত্রাকবিদ্যার ব্যাপক বিস্তার। ছত্রাক আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে, এমনকি আমাদের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে ছত্রাকবিদ্যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো। আমরা প্রতিদিনই ছত্রাকজাত খাদ্য গ্রহণ করি। ছত্রাক চাষ একটি বড় ব্যবসা হয়ে উঠেছে, বিশেষত মানুষের উদ্ভিদ ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে। তবে, কিছু নির্দিষ্ট ছত্রাক চাষযোগ্য হলেও অধিকাংশ সুস্বাদু ছত্রাক এখনো বন্যভাবে সংগ্রহ করতে হয়। যেমন চ্যান্টারেলস (Chanterelles), ট্রুফল (Truffle), ও মোরেলস (Morels)। ছত্রাক শুধু সুস্বাদু নয়, অত্যন্ত স্বাস্থ্যকরও। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন ছত্রাক খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪৫% কমতে পারে।
ছত্রাক প্রকৃতিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য পচনকারী জীব অপরিহার্য, কারণ এগুলো মৃত প্রাণী ও গাছপালার দৈহিক কাঠামোকে ভেঙে পরিবেশে পুনঃপ্রবেশ করায়। এছাড়া,
মাইকোরিজাই (Mycorrhizae)ছত্রাক উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে উদ্ভিদের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। ছত্রাক মানবজীবনে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯২৮ সালে পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামক ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন(Penicillin)আবিষ্কৃত হওয়ার পর চিকিৎসা জগতে বিপ্লব ঘটে, যা মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৩০ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। অপর দিকে ছত্রাক উদ্ভিদের সবচেয়ে বড় রোগ সৃষ্টিকারী। অনেক ক্ষতিকর ছত্রাক ধান, গম, ভুট্টা, কলা, টমেটো, তুলো এবং আরও অনেক ফসলকে সংক্রমিত করতে পারে। সাইলোসিবিন (Psilocybin)নামক যৌগযুক্ত বিশেষ ছত্রাকগুলো মানুষের চেতনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ছত্রাক নেশাসক্তি এবং বিষন্নতা নিরাময়ে কার্যকর হতে পারে।
ছত্রাক মানুষের জন্য ব্যাপকভাবে উপকারী, আবার কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকরও। কিন্তু কেন ছত্রাকবিদ্যার গবেষক সংখ্যা এত কম? সম্ভবত ব্যয়বহুল আর জটিল বলেই ছত্রাক গবেষণাকে সরকার বা বেসরকারি সংস্থাগুলি যথেষ্ট আকর্ষণীয় মনে করে না। যাই হোক না কেন, ছত্রাকবিজ্ঞানের গবেষণার পরিমাণ বৃদ্ধি মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।