
আমরা অনেকেই মাটির উপর ছত্রাক দেখলেই তাকে ‘ব্যাঙের ছাতা’ বা ‘মাশরুম’ ভাবি। কিন্তু ছত্রাকের আসলে ভিন্ন ভিন্ন ধরণ হয়। এদের সম্পূর্ণ একটি ভূগর্ভ-জগত আছে, সেটি আমরা যা দেখি তার থেকে ঢের জটিল এবং প্রকাণ্ড। অনেকসময়ই ছত্রাকদের জীবনধারণের আলাদা আলাদা নিজস্ব ধারা থাকে। ব্যাঙের ছাতা (মাশরুম), ইস্ট, ছাতা, ভেপনো এবং মরচে ছত্রাক প্রভৃতি হল ছত্রাকের পরিচিত রূপ। শরৎকালে বনভ্রমণের সময়, মরা কাঠের গুঁড়ির মধ্যে থেকে মাশরুম গজিয়ে উঠতে দেখি। ইস্ট হল পাউরুটি এবং কিছু পানীয় তৈরীর প্রয়োজনীয় উপাদান। ছাতা, ভেপনো, এবং মরিচা ছত্রাকগুলিরও বাণিজ্যিক গুরুত্ব আছে। কারণ, এইগুলি প্রায়শই ভুট্টা, গম প্রভৃতি প্রধান প্রধান ফসলগুলিতে আক্রমণ হানে । ছত্রাকের মাটির ওপরে দৃশ্য অংশটুকু প্রায় সব সময় প্রজনন মুখী। তাই এগুলিকে ‘ফলাঙ্গ’ বলা হয়। যদিও উদ্ভিদের মতন ছত্রাকরা ফল উৎপাদন করতে পারে না। এই ‘ফলাঙ্গ’গুলি বীজগুটি তৈরি করে, যা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিবেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে। আমরা যে মাশরুম খাই, তার ফুলকা থেকে বীজগুটি নির্গত হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, মাশরুমের টুপির নিচের দিকে ঝাপসা কিছু ঝালর রয়েছে- এগুলিই হলো তার ফুলকা। বীজগুটিগুলি বাতাসের চেয়ে হালকা। একটি মাশরুম যখন প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়, কেবলমাত্র তখনই সে এগুলিকে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। বাতাসে ভেসে ভেসে বহুদূর ছড়ায়। বীজগুটি ছড়ানোর আরেকটি মাধ্যম হলো জল। জলে ছড়িয়ে থাকা বীজগুটিগুলির আকার এমন হয় যাতে এগুলি ভেসে থাকতে পারে। কিছু গুটিতে, ফ্ল্যাজেলা (সরু লতানে কোষ) থাকে, এগুলির ঠেলায় গুটিগুলি সাঁতার কাটতে পারে ! এক ধরনের ‘পাখির নীড়ের’ মতন ছত্রাকের ফলাঙ্গগুলি ছোটো ছোটো কাপের আকৃতির হয় এবং এতে ছোট ছোট গুটির থলি থাকে। যা কিছুটা বাসায় পাড়া ডিমের মতন দেখতে! বৃষ্টির ফোঁটা এই কাপের উপরে এসে পড়লে ছত্রাকটি তার গুটি-থলিগুলি বাতাসে খুলে দেয়। আবার কিছু ছত্রাক গুটি ছড়ানোর জন্য প্রাণীদের উপরই নির্ভর করে, ঠিক ফুলগাছের পরাগায়নের মতন।
ছত্রাকদের নানারকম গন্ধ হয় – মিষ্টি ফলের সুবাস থেকে শুরু করে পচা মাংসের দুর্গন্ধ। এই গন্ধই, পোকামাকড় বা মরা দেহের উপর ঘুরতে থাকা মাছিদের আকৃষ্ট করে। একবার একটি গুটি সফলভাবে ছড়িয়ে পড়লে, সেটি পরবর্তীতে ছত্রাকে পরিণত হয়। মাটির নিচের দিকে এই ছত্রাক বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেখান থেকে ‘মাইসেলিয়াম’ বিকশিত হয়। এটি ছত্রাকের অ-প্রজননশীল উদ্ভিজ্জ অংশ। এটি হল কোষের একটি জালিকা, যা একেবারে আণুবীক্ষণিক স্তরের ক্ষুদ্র হতে পারে, আবার চোখে দেখাও যেতে পারে। শরৎকালে মাটির উপর ঝরা পাতা জমে। তখন মাটির উপরের স্তরটিকে সরিয়ে ফেললে, সেখানে তুলতুলে সাদা পদার্থ মিশে থাকতে দেখা যায়। এটিই হলো মাইসেলিয়াম- যা ছত্রাকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মাইসেলিয়াম মাটির নিচে কয়েক মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ‘ওরেগনের মধু ছত্রাক’, যা বিশ্বের বৃহত্তম জীব বলে গণ্য। মাইসেলিয়াম-এর কাজ মূলত উদ্ভিদ শিকড়ের মতোই পুষ্টি শোষণ করা, যদিও ছত্রাকরা উদ্ভিদদের মতন সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে নিজস্ব শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। পুষ্টি এবং শক্তির জন্য মাইসেলিয়ামের উপরেই তাদের ১০০% নির্ভর। ‘হাইফাই’ (hyphae) নামক ক্ষুদ্র লোমের মত কাঠামো দিয়ে মাইসেলিয়াম গঠিত। কোষের এই পাতলা স্তরগুলি ছত্রাকের জন্য জৈব যৌগগুলিকে, শক্তিতে রূপান্তরণে সাহায্য করে। হাইফাইগুলি উৎসেচক নিঃসরণ করে। এই উৎসেচক, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটের মতন বৃহৎ এবং জটিল খাদ্যকে ছোট এবং আরও ব্যবহারযোগ্য আকারে ভেঙে ফেলে। তারপর হাইফাই সরল যৌগগুলিকে মাইসেলিয়ামে পাঠায়। কিছু ছত্রাক তাদের পুষ্টির ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে। যেমন, উদ্ভিদের ক্ষতিকারক ছত্রাকগুলি। তারা কেবল ঐ নির্দিষ্ট উদ্ভিদ প্রজাতিটিকেই আক্রমণ করে, অন্য কোথাও থেকে পুষ্টি নিতে পারে না। কিছু কিছু ছত্রাক মৃত জৈব পদার্থকে ভেঙে, তা থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। জীবন যাপনকৌশলের দিক থেকে আকর্ষণীয় হলো এন্টোমো-প্যাথোজেনিক ছত্রাক। এরা পোকামাকড়ের মধ্যে অদ্ভুত রোগের সৃষ্টি করে। প্রথমে তাদের গুটি বাতাসে মিশে গিয়ে পোকার নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে ঢুকে গিয়ে তাদের সংক্রমিত করে। সেই গুটি পোকার শরীরের ভিতরে একটি ছত্রাকের আকার ধারণ করে, অবশেষে স্নায়ুতন্ত্রকে দখল করে নেয়। পোকাটি যখন উঁচুতে ওঠে, তখন ছত্রাকটি তার ফলাঙ্গ তৈরি করে পোকার দেহ থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর গুটিগুলি ছড়িয়ে পড়ে। তবে ছত্রাকের এই ফলাঙ্গ বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এরা মানুষ সহ অন্যান্য অনেক প্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এবং ওষুধের কাজ করে। মাইসেলিয়াম মাটিকে একসাথে ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ‘আঠা’ তৈরি করে। এই মাইসেলিয়াম না থাকলে বনের মাটি জলে ধুয়ে সাফ হয়ে যেতে পারে। অনেক ছত্রাকের সাথে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিথোজীবী-সম্পর্ক রয়েছে। মাইকোরিজাই (micorrhizae) নামক ছত্রাক এ রকমই এক মিথোজীবী সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।