ছায়াপথে মিশরীয় দেবী নুট

ছায়াপথে মিশরীয় দেবী নুট

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৭ মে, ২০২৫

একজন বিজ্ঞানী তার সন্তানদের সাথে সংগ্রহশালা পরিদর্শনে যান। তাঁর মেয়েটি তাঁকে আকাশ জোড়া ছায়াপথ ঘেরা এক মহিলার চিত্র দেখায়। মেয়ের ছোট্ট প্রশ্ন, তার বাবা ডঃ অর গ্রৌরকে, প্রাচীন মিশরীয় পুরাণের গভীরে গিয়ে ভাবাতে শুরু করে। প্রাচীন মিশরীয় শিল্পে কিভাবে ছায়াপথ চিত্রিত হল? এই ছোট্ট প্রশ্নই, অপ্রত্যাশিত এক যাত্রার সূত্রপাত ঘটায়। পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ গ্রৌর ও তাঁর দল প্রাচীন মিশর ও ছায়াপথ সম্পর্ক নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। তাঁদের মূল আকর্ষণ ছিল আকাশদেবী নুট। সাধারণত মিশরীয় কফিনে এই দেবীর চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে, অনেক দেব -দেবীকে স্বর্গীয় নক্ষত্র, সূর্য এবং এমনকি ছায়াপথের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী সত্তা হিসেবে দেখা হয়। নুট এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কল্পনা করা হয়, তিনি আকাশের প্রতিনিধি। তাঁর নিরাবরণ শরীরটি নক্ষত্র খচিত এবং ধনুকের মতন বাঁকা। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, নুট, প্রতি রাতে সূর্যকে গ্রাস করেন এবং ভোরে আবার সূর্যকে নতুন করে জন্ম দেন। তাঁর প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিটি পৃথিবীর উপর স্তম্ভিত আকাশ দেবতা ‘গেব’ যে পৃথিবীকে আশ্রয় দেয়, তারই প্রতীক। ৫,০০০ বছর আগে, সহস্র প্রাচীন কফিনে, এই প্রতীকী ভঙ্গি লক্ষ করা যায়। কিন্তু সর্বত্র ছবিগুলি এক রকমের নয়। প্রায় ৩,০০০ বছর আগে, নেসিতাউডজাতাখেতের এক গীতিনাট্যকার, আমুন-রে’ র কফিনে আলাদা চিত্র দেখা যায়। এখানে, নুটের শরীরের উপর একটি মোটা, ঢেউ খেলানো কালো রেখা রয়েছে। এটি তার পা থেকে হাত পর্যন্ত প্রসারিত। উপরে এবং নীচে সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে তারার সারি। এই অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যটিই বিজ্ঞানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। “আমি মনে করি , এই তরঙ্গায়িত বক্ররেখাটিই ছায়াপথকে প্রতিনিধিত্ব করে। ধুলোর অন্ধকার ছায়াপথের বিচ্ছুরিত আলোর উজ্জ্বল পটির মধ্য দিয়ে কেটে যায়। ছায়াপথের একটি ছবির সাথে এই চিত্রের তুলনা করলে,স্পষ্ট মিল দেখা যায় ” গ্রৌর ব্যাখ্যা করেন। এই বাঁকা নকশা কেবল একটি কফিনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যান্য বেশ কয়েকটি সমাধিতেও একই রকম রেখা দেখা যায়। “কিংস ভ্যালিতে সমাধিস্থ চারটি সমাধিতে, একই রকম ঢেউ খেলানো বক্ররেখা দেখা যায়। যেমন, ষষ্ঠ রামেসিসের সমাধি। এখানে, সমাধি কক্ষের ছাদ ‘দিনের বই এবং রাতের গ্রন্থের মধ্যে বিভক্ত ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই নুটের খিলানযুক্ত মূর্তিগুলি পরপর প্রদর্শিত এবং পুরু, সোনালী তির্যক বক্ররেখা দ্বারা পৃথক করা ছিল। এগুলি নুটের মাথার গোড়া থেকে বেরিয়ে তার পিঠের উপর দিয়ে, ভ্রাম্যমান।” দৃশ্যগত মিল থাকা সত্ত্বেও, গ্রৌর বিশ্বাস করেন না যে নুট সরাসরি ছায়াপথের প্রতিরূপ। মিশরীয় শিল্পে এই বক্ররেখা বিরল এবং তিনি বিশ্বাস করেন, এটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আরো বলেন,”আমি নুটের অন্য কোনও মহাজাগতিক উপস্থাপনায় এইরকম তরঙ্গায়িত বক্ররেখা দেখতে পাইনি এবং আমার মতে এই বক্ররেখার বিরলতা নিয়ে প্রাচীন গ্রন্থগুলির একটি গবেষণা, আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে নুট এবং ছায়াপথের মধ্যে একটি সংযোগ থাকলেও, দুটি এক এবং অভিন্ন নয়।” নুট দেবী, আকাশগঙ্গার প্রতিনিধিত্ব করেন না। বরং, সূর্য এবং তারার সাথে সাথে ছায়াপথও, আকাশের অন্যান্য উপাদানের মতন তার দেহকে সাজিয়ে তোলে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত একটি পূর্ববর্তী গবেষণার জন্য, ডঃ গ্রৌর ‘পিরামিড টেক্সটস’, ‘কফিন টেক্সটস’ এবং ‘বুক অফ নুট’ এর মতো প্রাচীন লেখাগুলি পরীক্ষা করেছিলন। তিনি রাতের আকাশের সিমুলেশনের সাথে তাদের তুলনা করে যুক্তি দেন যে ‘আকাশ দেবী নুটের মহিমার’ প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, এই ছায়াপথকে ব্যবহার করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ছায়াপথ, শীতকালে নুটের বাহুকে এবং গ্রীষ্মকালে তার মেরুদণ্ডকে চিহ্নিত করে। কিন্তু আরও গভীর অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে চাক্ষুষ চিত্রণ পরিবর্তিত হতে থাকে। “কফিন এবং সমাধির দেয়ালচিত্রে তার চাক্ষুষ চিত্র বিশ্লেষণ করে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় যা আক্ষরিক অর্থেই একটি ভিন্ন চিত্র এঁকেছে।” প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে , ছায়াপথ কেবল আলোর পটি নয়, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছায়াপথটি আসলে, পৌরাণিক কাহিনীর মহিমাময় সত্তা নুট এবং তারার মধ্যের এক সেতু!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − five =