‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ হল জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কাঠামো চুক্তির অনুষ্ঠিত বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন। বিশ্বের নানা দেশ, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নানা বিষয়ে তাদের যৌথ সিদ্ধান্ত নেয়। এই মঞ্চে কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি ও তার ক্ষতিপূরণ এবং জলবায়ুর জন্য অর্থের জোগান ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনাও হয়। ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলির দায়িত্ব বণ্টন, তহবিল প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন, এ সবকিছুর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রধান আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম এই ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’। এখানে গৃহীত সিদ্ধান্তই বিশ্বের জলবায়ু নীতি নির্ধারণ ও তার ভবিষ্যৎ-এর নির্ধারক।
ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গলের শহর বেলেম দো পারা। সেখানেই অনুষ্ঠিত হল, জাতিসংঘের এবারের জলবায়ু সম্মেলন COP30। শেষ দিনে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থার প্রধান সাইমন স্টিল এক প্রভাবশালী বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন, “অস্বীকার, বিভাজন আর ভূ–রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জের, আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে”। তবু তাঁর ভাষণে আশার কথাও ছিল। পৃথিবীকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধির সীমার মধ্যে ধরে রাখার লড়াই চলছে।
কিন্তু সম্মেলন কক্ষের বাইরে বাস্তবতার ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। ২০২৫ সালের মে মাসে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) সতর্ক করে দিয়েছিল, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে কোনো এক বছরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা শিল্প-পূর্ব যুগের তুলনায় ১.৫°C-এর ওপরে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮৬%। পাঁচ বছরের গড় তাপমাত্রা, এই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ৭০%। COP30-এর ঠিক আগে প্রকাশিত ‘জলবায়ুর অবস্থা ২০২৫’ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড গড়েছে। পরিবেশের ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের মধ্যে ২২টিই বিপদের মুখে। এই তথ্যের সঙ্গে সাইমন স্টিলের বক্তব্যের আশাবাদের মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই অবস্থায় জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) নতুন ‘অভিযোজন ঘাটতি প্রতিবেদন ২০২৫ সম্পদহীন পথচলা’ আরও হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে। রিপোর্টটি বলছে, ধনী দেশগুলির জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবে কার্যত ভেঙে পড়েছে। অসচ্ছল দেশগুলি নিজেরাই নিজেদের বাঁচাতে লড়াই করছে। কিন্তু সেই লড়াই চালানোর মতো অর্থ তাদের হাতে নেই।
জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতির ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৯৭–এর কিয়োটো চুক্তি, ২০০১–এর মারাকেশ তহবিল, এবং ২০০৯–এর কোপেনহেগেন সম্মেলনে ধনী দেশগুলো প্রতি বছর যে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়ার কথা বলেছিল , তা বহুবার পুনর্ব্যক্ত হলেও বাস্তবে বেশিরভাগ অর্থ আসে ‘ঋণ’ হিসেবে, অনুদান হিসাবে নয়। অর্থাৎ যারা জলবায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী, সেই দেশগুলোকেই আবার নতুন করে ঋণের ফাঁদে পড়তে হচ্ছে। UNEP–এর রিপোর্ট তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরে। যথা-
ক: ২০৩৫ সালের মধ্যে অভিযোজনের জন্য, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বছরে ৩১০–৩৬৫ বিলিয়ন ডলার করে অর্থ প্রয়োজন।
খ : ২০২৩ সালে ধনী দেশগুলির প্রকৃত অবদান মাত্র ২৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঋণ।
গ: প্রয়োজনের তুলনায় তহবিলের ঘাটতি বছরে ২৮৪–৩৩৯ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ১৭২টি দেশ আগেই ‘অভিযোজন পরিকল্পনা’ তৈরি করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাব, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর অনিয়মিত তহবিলের কারণে তাদের এক-পঞ্চমাংশ পরিকল্পনা এখন অচল। জলবায়ু অর্থের ঘাটতি পূরণের আরেকটি বহু আলোচিত পথ হল, ‘সবুজ বিনিয়োগ’। কিন্তু UNEP দেখিয়েছে, বেসরকারি খাতের অভিযোজন বিনিয়োগ ৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বেসরকারি খাতগুলি বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি দিতে পারবে না। এ অর্থ প্রয়োজনের কাছাকাছিও নয়। তাছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত ঝুঁকি কখনও নেন না। তারা আসে তখনই, যখন সরকার তাদের লাভের নিশ্চয়তা দেয়। একে বলে, “ডি-রিস্কিং” ব্যবস্থা। ফলে শেষ পর্যন্ত বোঝা চাপছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি কোষাগারে। COP30–এর পাশাপাশি বেলেমে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিপলস সামিট টুওয়ার্ডস COP30’। ২৫ হাজারের বেশি মানুষ এখানে অংশ নেন। গবেষক ও আন্দোলনকর্মীরা বলেন, সরকারি COP মঞ্চকে নিয়ন্ত্রণ করছে বড় বড় নিগম, বিশেষ করে ব্রাজিলের শক্তিশালী অ্যাগ্রোবিজনেস লবি। তাদের লক্ষ্য নিজেদের সবুজ বলে তুলে ধরা ও সরকারি তহবিলের উপর আরও দখল বাড়ানো।
প্রশ্ন রয়ে যায়, COP–এর মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নেওয়া কি আদৌ কার্যকর? জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে তিনটি কারণে COP এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
১. এখানে বিশ্বের ক্ষতিপূরণ, অনুদান এবং ন্যায্য দায়িত্ব বণ্টনের দাবি তুলতে পারা যায়।
২. এখানেই বহু আলোচিত “কমন বাট ডিফারেনশিয়েটেড রেস্পনসিবিলিটিজ” (অভিন্ন কিন্তু স্তরবিভক্ত দায়) নীতি রক্ষার লড়াইটা হয়।
৩. ধনী দেশগুলিকে বাধ্য হয়ে খোলা আলোচনায় আসতে হয়, সুতরাং চোরাগোপ্তা চুক্তির সুযোগ কমে।
জলবায়ু সংগঠন ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ ’–এর আসাদ রহমান মনে করেন, জলবায়ুর সংকট এখন আর কেবল জ্বালানির নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও সংকট। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন দেখিয়ে দেয়, ইচ্ছা থাকলে বিশ্ব ব্যবস্থায় সংস্কার এনে বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার তোলা সম্ভব। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কর আরোপ করা হলে দূষণকারীদের কাছ থেকে বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার আদায়ও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু একই সময়ে নেটো গোষ্ঠী মুক্ত দেশগুলি সামরিক বাজেট বাড়াতে ৫% জিডিপি বরাদ্দ করছে। বিশ্বের অন্যতম বড় কার্বন নির্গমনকারী খাত তো এই সামরিক খাতই। ব্রাজিলের ভূমিহীন কৃষক আন্দোলন MST–এর মতে, COP30 ছিল এক “দুমুখো আয়না”- একদিকে বাজারভিত্তিক সমাধানের উৎসব, অন্যদিকে মানুষের সংগঠন ও বাস্তব বিকল্প নির্মাণের শক্তিশালী উপস্থিতি। তাদের মতে, জলবায়ু সংকট আসলে, ‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রেণি সংঘাতেরই নতুন রূপ’ আর এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ পুঁজিবাদী মডেলের বাইরে লুকিয়ে রয়েছে, সংগঠিত জন আন্দোলনের মধ্যেই।
সূত্র : The Earth Is Unhappy with the Capitalist Climate Catastrophe: The Forty-Ninth Newsletter (2025); Tricontinental Newsletter; by Vijay; 4rth Dec; 2025.
