জলের ছিটেয় জীবন

জলের ছিটেয় জীবন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ মার্চ, ২০২৫

প্রাচীন পৃথিবীতে জীবন কীভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। নতুন এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলেছেন জীবন হয়তো বিশাল এক বজ্রপাত থেকে শুরু হয়নি। বরং ছোট ছোট বিদ্যুৎ চমকের মতো ঘটনায় জলের ছোট ছোট কণাগুলির মধ্যে শক্তি আদান-প্রদানের মাধ্যমে হয়েছিল। জলপ্রপাত বা সমুদ্রের বড় ঢেউ ভাঙলে বাতাসে জলের কণা ছিটকে যায়।স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এই জলের কণা সেসময়ের পৃথিবীর বাতাসে থাকা গ্যাসের সাথে মিশে গেলে কিছু বিশেষ জৈব অণু যেমন ইউরাসিল,( যা ডিএনএ ও আরএনএ-র অন্যতম উপাদান) তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ , জীবন গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো এধরনের সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মাধ্যমেও তৈরি হতে পারে।এই গবেষণাটি সাইন্স অ্যাডভান্সেস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে বহুল বিতর্কিত মিলার-ইউরে তত্ত্বে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ যোগ করেছে। মিলার-ইউরে তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে জীবন বজ্রপাতের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ১৯৫২ সালের একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, যদি জল ও কিছু নির্দিষ্ট গ্যাসের মিশ্রণে বিদ্যুৎ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে জৈব যৌগ (যা জীবনের মূল উপাদান) তৈরি হতে পারে।কিন্তু নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ছাড়াই যখন জলপ্রপাত বা ঢেউ ভাঙে, তখন জলের ফোঁটার মধ্যে ছোট ছোট বিদ্যুতিক আধান তৈরি হয়, যা নিজে নিজেই কাজটি করতে পারে। অর্থাৎ, শুধু জলের ছিটে থেকেও জীবন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী রিচার্ড জারে বলছেন, জলের ছোট ছোট ফোঁটাগুলোর মধ্যে বিপরীত আধান তৈরি হলে ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ ডিসচার্জ ঘটে। এই বিদ্যুতের ডিসচার্জই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব উপাদান তৈরি করতে পারে, যা আগের মিলার-ইউরে পরীক্ষাতেও দেখা গিয়েছিল।মনে করা হয় পৃথিবী গঠনের পর কয়েকশো কোটি বছর ধরে এখানে নানা রাসায়নিক উপাদান থাকলেও কার্বন-নাইট্রোজেন বন্ধনযুক্ত জৈব অণু প্রায় ছিল না। অথচ এই অণুগুলোই প্রোটিন, এনজাইম, ডিএনএ, ক্লোরোফিলসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরি করে।এই জৈব উপাদানগুলো তৈরীর পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত করে আসছে। মিলার-ইউরে পরীক্ষা এর এক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছিল—বজ্রপাত সমুদ্রের জলে আঘাত করে ও বাতাসে মিশে থাকা থাকা মিথেন, অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেনের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় এই অণুগুলো তৈরি হয়েছিল।কিন্তু এই তত্ত্বের সমালোচকেরা মনে করেন, বজ্রপাত খুব কম হয় আর সমুদ্র অনেক বড়, তাই শুধুমাত্র বজ্রপাত দিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ অণু তৈরি হওয়া বাস্তবে সম্ভব নাও হতে পারে।অধ্যাপক রিচার্ড জারে ও অন্যান্য গবেষক ইফান মেং, ইউ শিয়া ও জিনহেং সু একটি নতুন সম্ভাবনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।তারা প্রথমে দেখেন, জলের ফোঁটা ছিটেয় বিভক্ত হলে তারা ভিন্ন আধানযুক্ত হয়। বড় ফোঁটাগুলো সাধারণত ধনাত্মক হয়, আর ছোট ফোঁটাগুলো ঋণাত্মক । এই বিপরীত আধান যুক্ত ফোঁটাগুলো একে অপরের কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ ডিসচার্জ ঘটে। গবেষক জারে একে “অত ক্ষুদ্র বজ্রপাত বলেছেন, কারণ এটি মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ তৈরি হওয়ার মতোই কাজ করে। গবেষকরা উচ্চগতির ক্যামেরা ব্যবহার করে এই ছোট ছোট আলো ডিসচার্জ- এর ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। ক্ষুদ্র বিদ্যুতের ডিসচার্জ খুব ছোট এবং খালি চোখে দেখা না গেলেও এতে অনেক শক্তি থাকে।বিজ্ঞানীরা এটি পরীক্ষা করার জন্য নাইট্রোজেন, মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও অ্যামোনিয়ার একটি মিশ্রণে
সাধারণ তাপমাত্রার জল ছেটান। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই গ্যাসগুলো প্রাচীন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছিল।এর ফলে কার্বন-নাইট্রোজেন বন্ধন সহ জৈব অণু তৈরি হয় যার মধ্যে রয়েছে হাইড্রোজেন সায়ানাইড, অ্যামিনো অ্যাসিড গ্লাইসিন এবং ইউরাসিল।
গবেষকরা বলছেন, জীবনের সূচনা শুধু বজ্রপাতের কারণে হয়নি, বরং ঢেউ ভাঙা বা জলপ্রপাতের জলের ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ থেকেই এটি শুরু হয়ে থাকতে পারে।অধ্যাপক রিচার্ড জারে বলেছেন, প্রাচীন পৃথিবীতে সব জায়গায় জল ছিটিয়ে পড়ে পাথরে ধাক্কা খেয়ে বা ফাটলে ঢুকে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়।গবেষকরা জলের ছোট ছোট কণার শক্তি নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা দেখেছেন যে জলীয় বাষ্প অ্যামোনিয়া তৈরি করতে পারে, যা সারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এছাড়া, জলের ছোট ফোঁটা স্বাভাবিকভাবেই হাইড্রোজেন পারক্সাইড তৈরি করতে পারে। জারে বলেন, আমরা জলকে খুব সাধারণ বলে ভাবি কিন্তু এটি ছোট ছোট ফোঁটায় ভাগ হলে অনেক বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।অধ্যাপক রিচার্ড জারে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সদস্য, যেখানে জীববিজ্ঞান, হৃদরোগ, ক্যানসার ও মস্তিষ্ক গবেষণা নিয়ে কাজ করা হয়। এছাড়াও তিনি তিনি পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যানফোর্ড উডস ইনস্টিটিউটের সাথেও যুক্ত।এই গবেষণাটি বিমান বাহিনী বৈজ্ঞানিক গবেষণা অফিস এবং চীনের জাতীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × four =