জাইরোমর্ফ : উপাদান বিজ্ঞানে নবদিগন্ত  

জাইরোমর্ফ : উপাদান বিজ্ঞানে নবদিগন্ত  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২২ নভেম্বর, ২০২৫

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা নতুন এক ধরনের মেটামেটিরিয়াল তৈরি করেছেন। মেটামেটিরিয়াল হল কৃত্রিমভাবে তৈরি বিশেষ উপাদান যা সাধারণ প্রাকৃতিক উপাদানের ভৌত বৈশিষ্ট্য বর্জিত । এটির নাম “জাইরোমর্ফ”। এই উপাদানটি ভবিষ্যতের ফোটোনিক কম্পিউটারে, অর্থাৎ যেখানে বিদ্যুতের বদলে আলো ব্যবহার করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করা হবে, সেই ধরনের সুপার ফাস্ট কম্পিউটার গঠনে মস্ত পরিবর্তন আনতে চলেছে। আলো-চালিত কম্পিউটার অত্যন্ত দ্রুত ও শক্তি-সাশ্রয়ী হতে পারে, তবে এর অন্যতম মূল চ্যালেঞ্জ হলো চিপের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ক্ষুদ্র আলোক তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর তার সাথে এধরনের আলোক সংকেতকে সঠিক পথে পরিচালনা করা যাতে বাইরে থেকে আসা অবাঞ্ছিত আলোকে সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়া যায়। এ কাজের জন্য প্রয়োজন এমন উপাদান, যাকে বলা হয় আইসোট্রপিক ব্যান্ডগ্যাপ মেটেরিয়াল, যা সব দিক থেকেই আলোকে কার্যকরভাবে আটকে দিতে সক্ষম।

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা এর সমাধান হিসেবে কোয়াসিক্রিস্টাল-ভিত্তিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। কোয়াসিক্রিস্টাল এমন এক ধরনের কাঠামো, যা আকারে জটিল হলেও নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম মেনে চলে। আলো আটকানোর ক্ষমতা থাকলেও এতদিন এগুলোর একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল। এগুলো হয় কিছু বিশেষ দিক থেকে আসা আলোকে সম্পূর্ণরূপে বাধা দেয়, নয়তো সব দিক থেকে কিছুটা আলো বের করে দেয়। কিন্তু পুরোপুরি থামাতে পারে না। ফলে যাকে বলে আদর্শ উপাদান, যা সবদিক থেকে সমানভাবে আলো প্রতিরোধী, তা তৈরি করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে গবেষকরা কিছুটা ভিন্নধর্মী চিন্তা করেন। তাঁরা তৈরি করেন এমন এক অ্যালগোরিদম, যা সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল বা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল উপাদান নয়—যা মধ্যবর্তী ধরণের ‘সম্পর্কযুক্ত বিশৃঙ্খলা’। এই গবেষণা থেকেই জন্ম নেয় জাইরোমর্ফ। এই উপাদানটি একই সঙ্গে দু’ধরনের বৈশিষ্ট্যকে একত্র করে – এক, তরল-সদৃশ অবিন্যস্ততা এবং দুই, দূর থেকে দেখা বৃহৎ পরিসরে নিয়মিত প্যাটার্ন। গবেষকদের মতে, জাইরোমর্ফ কাঠামোর ভেতরে পরমাণুগুলি তরলের মতো বিশৃঙ্খল থাকে, কিন্তু সামগ্রিক বিন্যাসটি আবার নির্দিষ্ট দূরত্ব ও প্যাটার্ন অনুসরণ করে। অনেকটা যেমন, বনের গাছগুলো এলোমেলোভাবে থাকলেও একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। এই বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ই আলোর তরঙ্গকে সবদিক থেকে সম্পূর্ণরূপে আটকে দিতে সক্ষম শক্তিশালী ব্যান্ডগ্যাপ তৈরি করে।

তার ফলে এটি আগের যেকোনো পরিচিত উপাদানের তুলনায় শক্তিশালী এবং সর্ব অর্থে নির্ভরশীল ব্যান্ডগ্যাপ তৈরি করতে পারে। আলোর তরঙ্গ কোনো দিক থেকেই এই কাঠামোর ভেতর প্রবেশ করতে পারে না, যা ফোটোনিক কম্পিউটিং-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেখা গেছে, কার্যকর সব আইসোট্রপিক ব্যান্ডগ্যাপ উপাদানের মধ্যেই একটি সাধারণ কাঠামোগত স্বাক্ষর বা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। গবেষকরা এই স্বাক্ষরটিকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন, আর তাতেই পাওয়া যায় এই জাইরোমর্ফ—যার আলোক-নিরোধক ক্ষমতা কোয়াসিক্রিস্টালের থেকেও উন্নত ।

 

আগামী দিনে অতি-দ্রুত, শক্তি-সাশ্রয়ী ফোটোনিক কম্পিউটার, আলোক-ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং উন্নত অপটিক্যাল প্রযুক্তির বিকাশে এই জাইরোমর্ফ উপাদান বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি উপাদান বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

 

সূত্র : Gyromorphs: A New Class of Functional Disordered Materials by Mathias Casiulis, Aaron Shih,et.al; published in Physical Review Letters, 6th November,2025.

DOI: https://doi.org/10.1103/gqrx-7mn2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × five =