জাগুয়ারের গোপন জীবন

জাগুয়ারের গোপন জীবন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সম্প্রতি আমাজনের গভীর অরণ্যে গবেষকরা এক বিরল মুহূর্তের সাক্ষী হলেন। ব্রাজিলের সেরা দো পার্দো জাতীয় উদ্যানে পূর্ব অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো ক্যামেরাবন্দি করলেন এক কালো জাগুয়ার ও এক দাগওয়ালা জাগুয়ারের মিলন। ছয় মিনিটের সেই ভিডিও পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় শিকারি প্রাণীর গোপন জীবনযাত্রা সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করছে।

কালো জাগুয়ার আসলে আলাদা কোনো প্রজাতি নয়, বরং জাগুয়ার (প্যানথেরা ওনকা)-এরই একটি রঙিন বৈচিত্র্য। মেলানিজম নামক জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের শরীরে অতিরিক্ত রঞ্জক তৈরি হয়, ফলে গায়ের দাগ ঢাকা পড়ে গিয়ে দেখা যায় শুধু কালো রঙ। তবে আলোয় খেয়াল করলে জাগুয়ারের পরিচিত গোলাপি দাগগুলো ফুটে ওঠে। ঘন জঙ্গলে ছায়ার সঙ্গে মিশে গিয়ে শিকার ধরতে এই রঙ তাদের বাড়তি সুবিধা দেয়।

গবেষকেরা ক্যামেরার সাহায্যে যেটি রেকর্ড করেছেন, সেটি সত্যিই অভূতপূর্ব। অধ্যাপক কার্লোস পেরেস উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছেন, “আমরা যেন লটারি জিতেছি! কয়েক মিটার এদিক-ওদিক হলে এই দৃশ্য চোখের আড়ালেই থেকে যেত।” ভিডিওতে দেখা যায় পুরুষ জাগুয়ার ধীরে ধীরে কাছে আসছে, স্ত্রী প্রাণী বসে পড়ছে, তারপর মিলনের স্বাভাবিক ধাপগুলো এগিয়ে চলেছে, সবই তাদের বন্দিদশায় দেখা আচরণের সঙ্গে মিলে যায়।

 

দুটি মিলনের মাঝে বিরতি ছিল মাত্র তিন মিনিট। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘন ঘন সহবাস ডিম্বস্ফোটনে সহায়তা করতে পারে। এ সময়ই স্ত্রী প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা সর্বোচ্চ থাকে। মিলনের সময় পুরুষের গর্জন ও পরবর্তীতে স্ত্রীর গড়াগড়ি খাওয়ার আচরণ মিলনের সফলতার প্রমাণ বহন করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল স্ত্রী প্রাণীর শরীরে স্তন্যদানের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, অর্থাৎ তার শাবক থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাহলে কেন সে মিলনে রাজি হল? গবেষকেরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এটি হতে পারে এক ধূর্ত কৌশল। পিতৃত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে শাবকদের রক্ষা করা, যাতে পুরুষ জাগুয়ার শাবকদের হত্যা না করতে পারে।

মেলানিজম বা অতিরিক্ত কালো রঙের উপস্থিতি মূলত MC1R জিনের পরিব্যক্তি দ্বারা ঘটে। প্রায় ১০ শতাংশ জাগুয়ারে এটা দেখা যায়, আর্দ্র পরিবেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ সেখানে গাঢ় রঙ শরীরকে ছদ্মবেশে আড়াল করতে এবং তাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে মেলানিজম হয়তো আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এটি অন্যান্য জিনগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে গবেষকরা কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য খুঁজে পাননি।

তাই এই ঘটনার তাৎপর্য শুধু রোমাঞ্চকর নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও মূল্যবাহী। এটি প্রমাণ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশে জাগুয়ারদের প্রজনন আচরণ বন্দিদশার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ফলে সংরক্ষণ কর্মসূচি ও প্রজনন প্রকল্পে নতুন আশার আলো দেখা গেল।

 

সবশেষে বলা যায় , এ ঘটনা প্রযুক্তির শক্তিকে তুলে ধরলো আবারও। ক্যামেরা ছাড়া এমন বিরল মুহূর্ত কখনো নজরে আসত না। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আরও তথ্য দেবে: কালো রঙ কি প্রজননে কোনো ভূমিকা রাখে, নাকি সামাজিক আচরণে ভিন্নতা আনে, এই নিয়ে নিশ্চিত নিখুঁত তথ্য উঠে আসবে। গবেষণাটি জাগুয়ারের জীবনযাত্রার সাথে সাথে প্রত্যন্ত অ্যামাজন অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং কার্বনের সংরক্ষণ বোঝার জন্য বন্যপ্রাণী জরিপ এবং উদ্ভিদ অধ্যয়নকেও গুরুত্ব দেয়।

 

সূত্র: First Record of Mating Involving a Melanistic Jaguar (Panthera onca) in the Wild: Novel Behavioural Insights Into Colour Morphs and Captive-Wild Comparisons by Thomas Luypaert, et.al ; Ecology and Evolution (25.8.2025)

https://doi.org/10.1002/ece3.71776)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × three =