সমুদ্রের গভীরে, অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষুদ্র জীব প্রতিদিন পৃথিবীর জলবায়ুকে প্রভাবিত করে চলেছে। এই অতি ছোট প্রাণীদের বলা হয় ক্যালসিয়াম কার্বনেট উৎপাদক প্ল্যাঙ্কটন। এরা আসলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক কার্বন চক্রের অদৃশ্য নায়ক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আধুনিক জলবায়ু মডেলগুলোর বেশিরভাগেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীদের প্রভাব প্রায় উপেক্ষিত।
সম্প্রতি সায়েন্স জার্নালে ইউনিভার্সিটি অটোনোমা ডি বার্সেলোনার ইনস্টিটিউট অফ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (আইসিটিএ-ইউএবি) নেতৃত্বাধীন একটি দল এবিষয়ে গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, কোকোলিথোফোর, ফোরামিনিফার, এবং টেরোপডস নামক জলস্রোতে ভাসমান ক্ষুদ্র জীবগুলির ভূমিকা পৃথিবীর জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO₃) দিয়ে সূক্ষ্ম খোলস তৈরি করে, যা সমুদ্রের জলের রাসায়নিক গঠন পরিবর্তন করে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণ করে গভীর সমুদ্রে পাঠায়। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিই পৃথিবীর “কার্বন পাম্প” নামে পরিচিত, যা হাজার বছর ধরে জলবায়ুকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অধ্যাপক প্যাট্রিজিয়া জিভেরি বলেন, প্ল্যাঙ্কটনের খোলসগুলি দেখতে ছোট, কিন্তু তারা মিলিতভাবে পৃথিবীর সমুদ্র ও জলবায়ুর রসায়ন নির্ধারণ করে। এদের বাদ দিলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হারাব।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্ল্যাঙ্কটনদের তৈরি ক্যালসিয়াম কার্বনেটের বড় অংশই সমুদ্রের তলায় পৌঁছায় না। বরং তা উপরের স্তরেই দ্রবীভূত হয়ে যায়—যা “অগভীর স্তরে দ্রবীভবন” নামে পরিচিত। এটি অণুজীবের ক্রিয়া ও কণার মিশ্রণ প্রভৃতি জৈববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ঘটে। এই দ্রবীভবন সমুদ্রের রাসায়নিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনে। কিন্তু হতাশার বিষয়, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি এখনও পর্যন্ত বৈশ্বিক জলবায়ু মডেলগুলোতে (যেমন, সি এম আই পি ৬ আর্থ সিস্টেম মডেল) প্রায় অনুপস্থিত।
আরো দেখা গেছে, বিভিন্ন প্ল্যাঙ্কটন গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের পরিবেশগত ভূমিকা ও দুর্বলতা নির্ধারণ করে। কোকোলিথোফোররা ক্যালসিয়াম কার্বনেটের মূল উৎপাদক। কিন্তু তারা সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধির প্রতি খুব সংবেদনশীল। কারণ তাদের কোষ থেকে অম্লতা অপসারণ করার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে ফোরামিনিফার ও টেরোপডস সেকাজ করতে পারে, তবে তারা আবার উষ্ণতা ও অক্সিজেনের ঘাটতির শিকার।
তাই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলার চেষ্টা করছেন যে, এই জীবগোষ্ঠীগুলোর বৈচিত্র্য ও ভূমিকা উপেক্ষা করলে আমরা সমুদ্রের জলবায়ু প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একপেশে ধারণা পেতে পারি। তাই তাদের আহ্বান— প্ল্যাঙ্কটনদের উৎপাদন, দ্রবণ ও কার্বন সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে পরিমাপ করে জলবায়ু মডেলে যুক্ত করা প্রয়োজন।
অতএব, ভবিষ্যতের আরও নির্ভুল জলবায়ু পূর্বাভাস ও সমুদ্র–বায়ুমণ্ডল প্রতিক্রিয়ার বোঝাপড়ার জন্য এই হারিয়ে যাওয়া প্ল্যাঙ্কটন গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব পুনর্মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
সূত্র: “Calcifying plankton: From biomineralization to global change” by Patrizia Ziveri, Gerald Langer, et.al; (23.10. 2025), Science.
DOI: 10.1126/science.adq8520
