জিনোম নিয়ন্ত্রণের প্রাচীন উৎস

জিনোম নিয়ন্ত্রণের প্রাচীন উৎস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ মে, ২০২৫

ঠিক সময়ে জিন চালু আর বন্ধ করেই জীবনে বিবর্তন আসে। সরলতম কাঠামোর জীবও এটি করে থাকে। জিন নিয়ন্ত্রণের এই মৌলিক রূপটি, পৃথিবীর বুকে, জীবনের অস্তিত্বের মতোই পুরোনো। তবে ডিএনএ ক্রম জুড়ে স্বল্প দূরত্বে যেখানে এই জিন নিয়ন্ত্রণের কাজ হয়, সেই ‘সুইচ বোর্ড’টি সাধারণত একটি জিনের পাশে থাকে। দুটি সংস্থার যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, হাজার হাজার ডিএনএ অক্ষরের দূরত্ব থেকে জিন নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্ষমতা ৬৫ থেকে ৭০ কোটি বছর আগেই বিকশিত হয়েছিল, সম্ভবত প্রাণী বিবর্তনের একেবারে ঊষাকালে। পূর্বে যা ধারণা করা হতো, তার চেয়েও প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার আবির্ভাব ঘটেছিল। জিন নিয়ন্ত্রণ মূলত অত্যাধুনিক ক্রমে ডিএনএ এবং প্রোটিন ভাঁজ করার পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। জিনের সূচনাবিন্দু থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এই নিয়ন্ত্রণ-অঞ্চলগুলি, জিনকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে। সম্ভবত প্রথম বহুকোষী প্রাণীরা নতুন জিন আবিষ্কার না করেই, নিয়ন্ত্রণের এই অতিরিক্ত স্তরটির সাহায্যে বিশেষ কোষ এবং কলা আর অনুরূপ কোষ সমাবেশ তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনটি সম্ভবত সামুদ্রিক প্রাণীর অভিন্ন সাধারণ প্রজন্মের মধ্যে অথবা বিলুপ্ত সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই ছিল। প্রাচীন প্রাণীটি একটি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ডিএনএ ভাঁজ করার ক্ষমতা বিকশিত করে, ত্রিমাত্রিক স্থানে ক্রম তৈরি করে যা ডিএনএ’র দূরবর্তী একক বা ‘বিট’গুলিকে একে-অপরের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আনে। গবেষণা প্রধান ডঃ ইয়ানা কিম বলেন, “এই প্রাণীটি বহুকর্মা ‘সুইস ছুরির’ মতো বিভিন্ন উপায়ে তার জিন টুলকিট (জিনের ছোট উপগোষ্ঠী যার মধ্যে ভ্রূণবিকাশ এবং বিবর্তনীয় সম্ভাবনাগুলি সঞ্চিত থাকে) পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যা এটিকে বেঁচে থাকার উদ্ভাবনী কৌশলগুলিকে পরিমার্জন এবং বিবর্তিত হতে সাহায্য করে। আমরা আশা করিনি জটিলতার এই স্তরটি এতটা প্রাচীন !” এই আবিষ্কারগুলি মূলত উদ্ভিদের প্রাচীনতম শাখাগুলির জিনোম এবং ‘সামুদ্রিক আখরোট’ (Mnemiopsis leidyi), প্লাকোজোয়ান, সিনিডারিয়ান এবং ঝুঁটিওয়ালা জেলি মাছের জিনোম অন্বেষণ করে পাওয়া গেছে।

 

বিজ্ঞানীরা এককোষী জীবগুলিকেও অধ্যয়ন করেন। এরা আমাদেরই সাথে একটি অভিন্ন পূর্বপ্রজন্ম-উৎসের ভাগিদার। “এতদিন আমরা জিনোম-ক্রমের তুলনা করে আসছিলাম। কিন্তু এই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে, এখন আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে, কোন জিন-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া, জিনোমের কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে”। এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন সহ গবেষক আরনাউ সেবে-পেড্রোস। গবেষক দলটি ‘মাইক্রো-সি’ নামক একটি কৌশল ব্যবহার করে, ১১টি ভিন্ন প্রজাতির প্রতিটি কোষের ভিতরে ডিএনএ কীভাবে ভাঁজ হয় তা নকশায়িত করেন। উল্লেখ্য, মাপ হিসাবে প্রতিটি মানব কোষের নিউক্লিয়াসে প্রায় দুই মিটার লম্বা ডিএনএ থাকে। এইভাবে গবেষকরা প্রতিটি প্রজাতির ত্রিমাত্রিক জিনোম মানচিত্র তৈরির জন্য ১০ বিলিয়ন জিন-ক্রম তথ্য পরীক্ষা করেন। এককোষী আত্মীয়দের মধ্যে ‘দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণে’র কোনও প্রমাণ পাওয়া না-গেলেও, চিরুনি জেলি মাছ, প্লাকোজোয়ান এবং সিনিডারিয়ানের মতো আদিম শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট প্রাণীদের অনেক জিন লুপ ছিল। ‘জিন লুপ’ একটি জিনোমিক গঠন, যেখানে ডিএনএর একটি অংশ আরেকটি ডিএনএর অন্য অংশে আবদ্ধ থাকে। জিন বিন্যাসে ও জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

শুধুমাত্র সামুদ্রিক আখরোটের জিনোম ব্যেপে রয়েছে চার হাজারেরও বেশি লুপ। আবিষ্কারটি আশ্চর্যজনক! কারণ এই প্রাণীর জিনোমটি প্রায় ২০০ কোটি ডিএনএ অক্ষর দীর্ঘ। মানুষের জিনোম ৩১০ কোটি অক্ষর দীর্ঘ। আমাদের কোষগুলিতেও হাজার হাজার লুপ থাকতে পারে। যাইহোক, চিরুনি জেলি ফিশ এমন জীবনরূপ থেকে এসেছে যা প্রায় ৬৫০-৭০০ কোটি বছর আগে অন্যান্য প্রাণীবংশ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। জীবন তালিকায় স্পঞ্জের চেয়ে ঝুঁটিযুক্ত জেলিগুলি পুরানো কিনা তা বিবর্তনী জীববিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের বিতর্কিত বিষয়। তবে এই গবেষণাটি দেখায় যে জিনের দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ, পূর্বের ধারণার চেয়েও কম করে ১৫০ কোটি বছর আগেই উদ্ভূত হয়েছিল।

এই গবেষণায় আরেকটি আশ্চর্যজনক আবিষ্কার হল এরা বেশিরভাগই মেরুদণ্ডী প্রাণী। তাদের কোষে, লুপগুলি CTCF দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। CTCF একটি মূল স্থাপত্য প্রোটিন যা জিনোমের ত্রিমাত্রিক কাঠামোকে সংগঠিত করার কাজে এবং জিন অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর এবং মাছের জিনোম-স্থাপত্যের একটি মৌলিক একক। আবিষ্কার হয় চিরুনি জেলি একই কাঠামোগত পরিবারের অন্তর্গত একটি ভিন্ন স্থাপত্যযুক্ত প্রোটিন ব্যবহার করে। স্পঞ্জ এবং চিরুনি জেলির মতো, মানুষও ডিএনএর একই কাঠামো দিয়ে তৈরি। আজ, আমাদের দেহ একই ডিএনএ থেকে বিভিন্ন ধরণের কোষ তৈরি করতে ‘দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণে’র প্রাচীন উদ্ভাবনের উপর নির্ভর করে। মস্তিষ্কের কোষ থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধী কোষ পর্যন্ত সবকিছুই এই দিয়ে তৈরি হচ্ছে। এই যোগাযোগগুলিতে ভুল হলেই রোগের সৃষ্টি হয়। বহু কোটি বছর আগে, জীবিত প্রাণীদের ‘দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণে’র সন্ধান করে, গবেষকরা জিনোমিক নিয়ন্ত্রণের প্রাচীনতম সংস্করণগুলি কীভাবে রূপ নিয়েছিল তা একত্রিত করতে শুরু করেছেন। এ থেকে আমাদের কোষ এবং দেহ নিয়ন্ত্রণকারী মৌলিক নীতিগুলি সম্পর্কে নতুন সূত্র উঠে আসবে। প্রক্রিয়াটির শক্তি ও দুর্বলতা বুঝতে এটি সাহায্য করতে পারে। হয়তো এই গবেষণা নতুন চিকিৎসা অন্তর্দৃষ্টি বা থেরাপির পথ খুলে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + two =