জিন-‘আবর্জনা’: আঁধারে আলো

জিন-‘আবর্জনা’: আঁধারে আলো

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১ আগষ্ট, ২০২৫

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মানব ডিএনএর একটা বিশাল অংশকে “জিনগত আবর্জনা” মনে করতেন। এগুলি পুরোনো ভাইরাসের ছায়া, যেগুলো বহু কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের জিনে ঢুকে পড়েছিল। এই অংশগুলিকে বলা হয় স্থান পরিবর্তনশীল জিন উপাদান বা TEs। এরা নিজের অনুলিপি বারবার জিনোমে ছড়িয়ে দেয়। আগে মনে করা হত, এরা নীরব এবং নিষ্ক্রিয়। কিন্তু নতুন একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জানাচ্ছে, এই তথাকথিত ‘আবর্জনা’ আসলে আমাদের জিন নিয়ন্ত্রণেরই এক সক্রিয় প্রক্রিয়া। এই গবেষণার কেন্দ্রে ছিল একটি ভাইরাল ডিএনএ পরিবার, নাম-MER11। এটি দীর্ঘ টার্মিনাল রিপিটযুক্ত রেট্রোট্রান্সপোজ শ্রেণির অন্তর্গত। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪ কোটি বছর আগে এই MER11 প্রাইমেটদের জিনে প্রবেশ করেছিল। অদ্ভুত বিষয় হল, এই অংশগুলি আজও সক্রিয়। এমনকি মানুষের স্টেম সেল ও স্নায়ু কোষের বিকাশে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। MER11 কেবল একরকম নয়। গবেষণায় চারটি উপশ্রেণি শনাক্ত হয়েছে। MER11\_G1 থেকে MER11\_G4। যেখানে G1 প্রাচীনতম আর G4 তরুণতম। আশ্চর্যের ব্যাপার, নবীন এই G4 টাইপটি ‘জিন চালু করা’-র কাজে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। এটি কীভাবে কাজ করে? বিজ্ঞানীরা একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যাতে ৭০০০ MER11 ক্রম পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল চমকে দেওয়ার মতো! MER11\_G4 মানুষের স্টেম সেল ও স্নায়বিক কোষে জিনের কার্যকারিতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এই অংশে রয়েছে বিশেষ ধরনের জিন-নিয়ন্ত্রণ প্রোটিনের সংযুক্তির স্থান: ডিএনএর এমন কিছু জায়গা যেখানে নিয়ন্ত্রক প্রোটিন এসে বসে জিনকে চালু বা বন্ধ করতে পারে। অর্থাৎ, MER11\_G4 মূলত একটি জিন সুইচের কাজ করে।
মানুষ, বানর আর মাকাক প্রজাতির বানরদের মধ্যে MER11\_G4 ক্রমে কিছু পার্থক্য পাওয়া গেছে। যা হয়তো প্রজাতিভিত্তিক জিন নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে। এই পার্থক্যগুলো হয়তো বিবর্তনের ধারায় নতুন প্রজাতির উদ্ভব বা বিশেষায়নের সম্ভাব্য উৎস। MER11 বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল এবং নিউরাল প্রোজেনিটার কোষে। এগুলি শরীরের যেকোনো কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। মস্তিষ্ক গঠনের সাথে সংযুক্ত জিনের আশপাশে MER11 পাওয়া গেছে। এতে স্পষ্ট যে এই ভাইরাল ডিএনএর অংশ আমাদের স্নায়বিক বিকাশে একটি গোপন অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানী ড. শান চেন বলেন, “MER11\_G4 একটি ভিন্ন ধরণের ‘জিন পাঠ নিয়ন্ত্রণকারী প্রোটিন’- এর সাথে যুক্ত। এর মধ্যে ক্রম পরিবর্তন মারফত নতুন নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা এসেছে। প্রজাতি তৈরির প্রক্রিয়ায় এটির হয়তো ভূমিকা আছে।” অন্যদিকে, ড. ইনোউয়ে বলেন, “আমাদের জিনোম বহু আগেই সিকোয়েন্স করা হয়েছে বটে, কিন্তু এর অনেক অংশের কাজ আজও অজানা।” এই গবেষণা সেই অজানা অংশের দিকে আলো ফেলেছে। একসময় যেগুলোকে জৈবিক কঙ্কাল ভেবে ফেলে রাখা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সেগুলোই আমাদের জিন নিয়ন্ত্রণের নেপথ্য নায়ক। সময় আর কোষ একসাথে লিখে যাচ্ছে জীবনের মৌলিক সূত্র।

সূত্র : Extensive fluvial surfaces at the East Antarctic margin have modulated ice-sheet evolution” by Guy J. G. Paxman, Stewart S. R. Jamieson, Neil Ross, Michael J. Bentley, Charlotte M. Carter, Tom A. Jordan, Xiangbin Cui, Shinan Lang, David E. Sugden and Martin J. Siegert, 11 July 2025, Nature Geoscience.
DOI: 10.1038/s41561-025-01734-z

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + 3 =