জিন এডিটিং ও রক্ত -মস্তিস্ক বেড়াজাল

জিন এডিটিং ও রক্ত -মস্তিস্ক বেড়াজাল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মানবমস্তিষ্ক বিজ্ঞানের কাছে সবচেয়ে রহস্যময় এবং দুরূহ অঙ্গ। তবে সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। ক্রিসপার–ক্যাস৯ (CRISPR–Cas9) নির্ভর জিন এডিটিং প্রযুক্তি এখন ধীরে ধীরে মস্তিষ্কঘটিত রোগ নিরাময়ের দিকে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যেই রক্ত, লিভার ও চোখের মারাত্মক রোগ নিরাময়ে এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। ট্রামবুল, কানেটিকাটের রেট সিন্ড্রোম রিসার্চ ট্রাস্ট–এর প্রতিষ্ঠাতা মোনিকা কোয়েনরাডস, আশান্বত হয়ে জানিয়েছেন, “আগের তুলনায় এখনকার তথ্য অনেক বেশি শক্তিশালী। এ আর কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়, আসল বাস্তবের কাছাকাছি।” কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক শিশু প্রাণঘাতী লিভারের জিনগত রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছে একটি কাস্টমাইজড(প্রয়োজনানুগ) জিন থেরাপির মাধ্যমে। সেখানে ব্যবহৃত ফ্যাটি ন্যানোপার্টিকল লিভারে জমা হয়ে চিকিৎসা পৌঁছে দেয়। তবে মস্তিষ্কে একই কৌশল কার্যকর করা অনেক জটিল। কারণ, মস্তিষ্ককে ঘিরে থাকা রক্ত-মস্তিষ্ক বেড়াজাল অধিকাংশ পদার্থকেই আটকে দেয়। ফলে গবেষকেরা এমন এক সরবরাহ ব্যবস্থা খুঁজছেন যা ওই বেড়া টপকে যেতে পারে। এদিকে রোগী ও তাদের পরিবারগুলির মধ্যে হতাশা বাড়ছে। “ওই শিশুটির চিকিৎসা এত দ্রুত হলো, কিন্তু আমাদের বেলায় এত দেরি কেন?”—এমন প্রশ্নই বারবার শুনছেন কোয়েনরাডস। স্নায়ুর ক্ষয়জনিত রোগে আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কারণ জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমে এখন শিশুদের খিঁচুনি, মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা বা আচরণগত ব্যাধির সুনির্দিষ্ট জিনগত কারণ চিহ্নিত হচ্ছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং হল ডিএনএ-র নিউক্লিওটাইডের ক্রম নির্ণয় করার প্রক্রিয়া। ইঁদুরের উপর পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণা অনেক আশা জাগিয়েছে। ২০২৩ সালে এমআইটি–হার্ভার্ডের ব্রড ইনস্টিটিউটের ডেভিড লিউ এবং সহকর্মীরা ‘প্রাইম এডিটিং’ নামক একটি জিন-এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে শৈশবের রক্ত ক্ষরণ ঘটিত এক মারাত্মক রোগের জন্য দায়ী পরিব্যক্তিকে সংশোধন করেছেন। ফলাফল চমকপ্রদ। ইঁদুরের অর্ধেক কর্টেক্সে পরিব্যক্তি ঠিক হয়ে যায়, খিঁচুনির তীব্রতা কমে, শেখার ক্ষমতা বাড়ে এবং আয়ুষ্কালও বৃদ্ধি পায়। লিউ বলছেন, “আমরা সত্যিই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম।” একই সঙ্গে তাঁর ল্যাবে হান্টিংটনস ডিজিজ ও ফ্রিডরিখস অ্যাটাক্সিয়ার মতো মারাত্মক স্নায়বিক রোগের জন্যও এটিকে নিয়ে কাজ চলছে। ওদিকে চীনের শাংহাই জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়ের জি লং কিউ-এর দল বেস এডিটিং ব্যবহার করে MEF2C জিনের পরিব্যক্তি সংশোধন করেছে। এটি মানুষের মৃগী ও মানসিক বিকাশঘটিত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ইঁদুরে এই পরিবর্তন সামাজিক আচরণকে স্বাভাবিক করে এবং নিউরনদের মধ্যে সংযোগ উন্নত করে। রেট সিন্ড্রোম প্রায়শই MECP2 জিনের পরিব্যক্তির কারণে হয়। সেখানে প্রচলিত জিন থেরাপি কাজ দেয় না। কারণ অতিরিক্ত MECP2 প্রোটিন স্নায়ুর জন্য বিষাক্ত হতে পারে। কিন্তু জিন এডিটিং শুধু ত্রুটিপূর্ণ জিনটিকেই সংশোধন করবে, ফলে ঝুঁকি কম। কোয়েনরাডস বলেন, “রেট সিন্ড্রোমের জন্য এই কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” কিউ-এর আশা, বছর পাঁচেকের মধ্যে তাঁর দল মানুষের উপর বেস এডিটিং কৌশল প্রয়োগ করতে পারবে। লিউয়ের দলও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এএইচসি রোগীদের জন্য মানুষের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যয়ে পৌঁছতে চায়। এখনও পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কে জিন এডিটিং পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ধরা হচ্ছে অ্যাডেনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস ৯ (AAV9)-কে। এটি সীমিত মাত্রায় রক্ত-মস্তিষ্ক বেড়াজাল টপকে যেতে পারে। তবে উচ্চ মাত্রায় এটি আবার প্রাণঘাতী প্রতিরোধ তান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই গবেষকেরা উন্নততর ভাইরাস কিংবা ভাইরাস–মুক্ত চালানি ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে বড় বাধা সম্ভবত অর্থনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বায়োটেক ক্ষেত্রটি দীর্ঘ মন্দার মধ্যে আছে। ব্যয়বহুল ও জটিল এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীরা অনীহা দেখাচ্ছেন। “টাকার জোগান শুকিয়ে যাচ্ছে,” বলছেন কোয়েনরাডস। তবুও তিনি আশাবাদী—“বিজ্ঞান সবসময় দোলকের মতো এদিক ওদিক করে। আমাদের এখন শুধু ঘাড় গুঁজে ভালো তথ্য তৈরি করতে হবে।”

সূত্র : Brain editing now ‘closer to reality’: the gene-altering tools tackling deadly disorders by Heidi Ledford ; Nature(14 August, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − four =