
ড্রাগ-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে এক অপ্রত্যাশিত নায়করূপে উঠে এসেছে বিষ। একসময় শুধু প্রাণঘাতী শক্তি হিসেবে পরিচিত সাপ, বিছে ও মাকড়সার বিষ এখন বহু- ওষুধ-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া মোকাবিলার সম্ভাব্য অস্ত্র হিসেবে গবেষণায় ব্যবহৃত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আণবিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ে বিষের লুকানো অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষমতার কথা জানতে পেরেছেন। তাদের গবেষণা নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু বহু- ড্রাগ-প্রতিরোধী সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষত গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যাদের বাইরের শক্ত আবরণ অনেক অ্যান্টিবায়োটিককে বাধা দেয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ এক বড় চ্যালেঞ্জ। বিষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তিত হয়ে ক্ষুদ্র প্রোটিন বা পেপটাইডে সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ ও বিনাশ করতে বিশেষভাবে সক্ষম। এই প্রক্রিয়া অনেকটা অ্যান্টিবায়োটিকের কাজেরই মতো। তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিষের পেপটাইড নিয়ে গবেষণা এতদিন খুব কম হয়েছে।
গবেষক দল ‘অ্যাপেক্স’ নামে একটি ডিপ-লার্নিং সিস্টেম ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সংগৃহীত ১৬,১২৩টি বিষ প্রোটিন বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা সেগুলোকে ভেঙে ৪ কোটিরও বেশি পেপটাইড খণ্ডে রূপান্তরিত করেছেন। সেখান থেকে ৩৮৬টি সম্ভাবনাময় পেপটাইড বেছে নেওয়া হয়, যাদের গঠন ও বৈশিষ্ট্য ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর ভেদ করার জন্য আদর্শ।
এরপর গবেষকরা ল্যাবে ৫৮টি পেপটাইড সংশ্লেষণ করে পরীক্ষায় ব্যবহার করেন। ফলাফল ছিল চমকপ্রদ।৫৩টি পেপটাইড সফলভাবে ব্যাকটেরিয়া বিনাশ করে, অথচ মানুষের লোহিত রক্তকণিকাকে অক্ষত রাখে। এটি সম্ভাব্য নিরাপদ ব্যবহারের ইঙ্গিত। পাশাপাশি গবেষণায় ২,০০০টিরও বেশি নতুন অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল মোটিফ (অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্ষুদ্র শৃঙ্খল) চিহ্নিত করা হয়।
প্রাণীর উপরে পরীক্ষার জন্য, তারা কিছু পেপটাইড ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করেন যেগুলো Acinetobacter baumannii নামক বিপজ্জনক গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল। চিকিৎসার ফলে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং কোনো বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বর্তমানে দলটি এসব পেপটাইডের রাসায়নিক গঠন আরও উন্নত করে স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা বাড়ানোর কাজ করছে।
এই গবেষণার ফলে জীববিজ্ঞান ও এ আই-এর সমন্বয়ে ওষুধ আবিষ্কারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আগে একেকটি অণু খুঁজে বের করতে বছর ঘুরে যেত। এখন কয়েক ঘণ্টায় সম্ভাব্য উপাদানকে শনাক্ত ও পরীক্ষা করা সম্ভব।
প্রকৃতি এখনো আমাদের অবাক করার ক্ষমতা রাখে। একসময় যার প্রাণঘাতী শক্তির জন্য আমরা আতঙ্কিত হতাম, সেই বিষই হয়তো হয়ে উঠতে পারে জীবনরক্ষাকারী অস্ত্র। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকায়, প্রকৃতির গোপন রাসায়নিক ভাণ্ডার খুঁজে দেখা হয়তো টিকে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে উঠবে। আরও গবেষণা হলে, আগামী প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক হয়তো কোনো পরীক্ষাগারের পেট্রি-ডিশ বা মাটির নমুনা থেকে নয় বরং এমন সব প্রাণীর দাঁত ও হুল থেকে আসবে, যাদের থেকে একসময় আমরা প্রাণপণে পালাতাম।
সূত্র: Computational exploration of global venoms for antimicrobial discovery with Venomics artificial intelligence by Changge Guan, et.al ; Nature Communications (12.7. 2025).