জুরাসিক যুগের দৈত্য

জুরাসিক যুগের দৈত্য

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২০ নভেম্বর, ২০২৫

চীনের চংচিং প্রদেশের টঙনান জেলায়, খননকারীরা সাধারণ ভূতাত্ত্বিক স্তরে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। তখন তাঁরা জানতেন না, ১৪৭ কোটি বছরের পুরোনো এমন এক জীবাশ্ম উঠে আসবে যা আমাদের ডাইনোসর সম্পর্কিত ধারণাকেই পাল্টে দেবে! এই জীবাশ্মটি এক নবআবিষ্কৃত দীর্ঘ ঘাড়ওয়ালা সওরোপড ডাইনোসরের। এর নাম দেওয়া হয় টঙনানলং ঝিমিঙ্গি। দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৭৫ থেকে ৯২ ফুট। এ যেন প্রাগৈতিহাসিক বিশ্বের এক জীবন্ত আকাশচুম্বী মিনার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই জীবটি পৃথিবীতে বিদ্যমান ‘বিশালতার সীমা’ নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

সংগৃহীত জীবাশ্মটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল নয়। এটি একটি হোলোটাইপ নমুনা বা একমাত্র প্রামাণিক নমুনা। এতে পাওয়া গেছে তিনটি পিঠের কশেরুকা, ছয়টি লেজের কশেরুকা, কাঁধের পাতার অংশ এবং পিছনের পায়ের কয়েকটি হাড়। আকারগত দিক থেকে হাড়গুলির কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত প্রজাতি হল, মামেনচিসরুস ইয়োঙ্গি। হাড়গুলির ভিতরে যেসব বাতাসে-ভরা ক্ষুদ্র গহ্বর, মজবুত কশেরুকার রিজ, এবং শক্তিশালী স্নায়ুকাঁটা আছে সেগুলোই এই ডাইনোসরের দেহকে অত্যন্ত হালকা অথচ পেশিবহুল করে তুলেছিল। অর্থাৎ, আকস্মিক ভাবে নয়, নিখুঁত জৈব-প্রকৌশলের মাধ্যমেই বিবর্তন তাকে এমন বিশাল করে তুলেছিল। সওরোপডদের বিশালতার রহস্য একরৈখিক নয়। এটি এক বিবর্তনীয় ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া-শৃঙ্খল। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন “বিবর্তনীয় কাসকেড মডেল” বা ‘ধারাবাহিক বিবর্তনীয় প্রভাবের মডেল’। এই তত্ত্ব বলছে, ছোট মাথা মাত্রেই দীর্ঘ ঘাড়কে ধারণ করা সহজ করে। দীর্ঘ ঘাড় মানেই দূরে দাঁড়িয়ে প্রচুর শাকপাতা খাওয়ার সুবিধা। পাখির মতো কার্যকর বায়ুপ্রবাহের শ্বাসপ্রণালী মানেই কম শক্তি ব্যয়ে বিশাল আকারে বাড়ার সুবিধা। আবার দ্রুত বৃদ্ধি মানেই শিকারীর হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনা।

টঙনানলং ঝিমিঙ্গি–র হাড়ে ঠিক এই ধারার সমস্ত গঠনগত বৈশিষ্ট্য মিলেছে। তাই সে শুধু এক বিশালাকার ডাইনোসরই নয়, সে এক বিশেষায়িত বিবর্তনীয় প্রকল্প। যে প্রকল্প সওরোপডদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে প্রকাশ করতে দিয়েছে। ডাইনোসরটির হাড়টি মিলেছে, সুইনিং ফর্মেশন নামের ভূস্তরে। ‘সুইনিং স্তর-গঠন’ জুরাসিক যুগের এক শুষ্ক, হ্রদ সংলগ্ন পরিবেশকে নির্দেশ করে।

মৌসুমি বন্যা বা তীব্র আবহাওয়াই এই বিশাল ডাইনোসরের দেহকে মৃত্যুর পর, দ্রুত কাদার নীচে চাপা দেয়। সেই কারণেই জীবাশ্ম সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। এই প্রজাতির নিকট আত্মীয় পাওয়া গেছে আফ্রিকার টেন্ডাগুরু অঞ্চলে। ফলত আগের যে ধারণা, পূর্ব এশিয়া জুরাসিক যুগে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল, তা এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। মহাদেশগুলোর প্রাচীন সংযোগ মানচিত্র আরও জটিল হয়ে উঠছে। এর সম্পূর্ন ঘাড় বা সামনের অংশের হাড় অবশ্য পাওয়া যায়নি। তবুও যে অংশটুকু পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন, এটি আমাদের ‘দেহ-আকারের সীমা’ বিষয়ক ধারণাকে পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য করবে। বিশাল আকার মানেই অধিক খাবারের প্রয়োজন, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিচরণ, উচ্চ শরীর-তাপ নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রতিরক্ষার ভিন্ন কৌশল। সব মিলিয়ে এই ডাইনোসর প্রমাণ করছে, বিবর্তন শুধু অভিযোজন নয়, সীমা ভাঙার আঁকিবুঁকিও।

 

সূত্র : A new mamenchisaurid from the Upper Jurassic Suining Formation of the Sichuan Basin in China and its implication on sauropod gigantism by Xurfang Wei; et.el; Scientific Reports; 10th July 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − 3 =