জুরাসিক যুগের সাগর সরীসৃপ

জুরাসিক যুগের সাগর সরীসৃপ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

জার্মানির বাভারিয়ার মিস্টেলগাউ অঞ্চলের এক পুরনো কাদামাটির খাদ থেকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এক বিলুপ্ত সামুদ্রিক সরীসৃপের নতুন প্রজাতি। প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগ নিবাসী এই প্রাণীটির নাম রাখা হয়েছে ইউরাইনোসরাস মিস্টেলগাউয়েন্সিস (Eurhinosaurus mistelgauensis)। এই আবিষ্কার শুধুই এক নতুন প্রজাতির সংযোজন নয়। এটি প্রাচীন সামুদ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করতে বিশেষ সহায়ক বলে মনে করছেন গবেষকরা। মিস্টেলগাউয়ের যেখান থেকে জীবাশ্মটি উদ্ধার হয়েছে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্ম খননের জন্যই পরিচিত। ১৯৯৮ সাল থেকে উরভেল্ট-মিউজিয়াম ওবারফ্রাঙ্কেন এই অঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে আসছে। ২০০০ সালের দিকে উদ্ধার করা জীবাশ্মটি সম্প্রতি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি অদৃষ্টপূর্ব এক নতুন ইকথিওসরের (সমুদ্রচর সরীসৃপ) নমুনা। এটি দেখতে বেশ অদ্ভুত। উপরের চোয়াল, নীচের চোয়ালের তুলনায় অনেক লম্বা, যা কিছুটা আধুনিক সোর্ডফিশ বা ডলফিনের মতন। ধারণা করা হচ্ছে, এটি এমনভাবে গঠিত, যাতে দ্রুতগতিতে জলের নীচে শিকার ধরতে পারে। এছাড়াও এর পাঁজরের হাড় বেশ মোটা ও শক্ত । বোঝা যায়, এটি হয়তো গভীর জলের চাপে টিকে থাকতে সক্ষম ছিল। গবেষণা দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরাসিকা মিউজিয়ামের জীবাশ্মবিদ গায়েল স্পিশার। তিনি বলেছেন, “এই জীবাশ্মটি শুধু আকর্ষণীয় নয়, উপরন্তু ইকথিওসরদের বিবর্তন ও তাদের পরিবেশগত অভিযোজন সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করছে।” তিনি আরও বলেন, এই প্রজাতির মাথার খুলি এবং ঘাড়ের হাড়ের গঠনে যে পার্থক্য দেখা গেছে, তা একে আগের পরিচিত ইউরাইনোসরাস প্রজাতিগুলোর থেকে আলাদা করে। ইতিপূর্বে এই প্রজাতির প্রাণীদের জীবাশ্ম ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে পাওয়া গেছে। কিন্তু মিস্টেলগাউ থেকে পাওয়া নমুনাটি আকারে ও গঠনে ভিন্ন। এর মাথার খুলি একটু ব্যতিক্রমী। পাঁজরের হাড়ও অন্যগুলোর তুলনায় মোটা ও ঘন।
গবেষকদের মতে, এই ভিন্নতা খুব সম্ভব ভৌগোলিক অভিযোজনের ফল। জার্মানির তৎকালীন সামুদ্রিক পরিবেশ ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের তুলনায় আলাদা ছিল, যার ফলে এই প্রজাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়েছে। জীবাশ্মটি যে স্তরে পাওয়া গেছে, তা ছিল তোয়ারসিয়ান স্তরের অংশ- যা প্রায় ১৮ কোটি বছর আগের পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ নির্দেশ করে। আশপাশে প্রচুর বেলেমনাইট (প্রাচীন মাথাফুটো প্রাণী, বর্তমান স্কুইডের পূর্বপুরুষ) জীবাশ্ম পাওয়ায়, ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশটা ছিল একটিই শিকারীর। এই আবিষ্কার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিজ্ঞানীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে।
১. জীববৈচিত্র্য বোঝা- নতুন এই প্রজাতি ইঙ্গিত দেয় যে ইকথিওসরদের মধ্যে আরও বৈচিত্র্য ছিল, যা আগে জানা ছিল না।
২. ভৌগোলিক বিস্তৃতি নির্ধারণ- এটি দেখায় যে ইউরাইনোসরাস শুধু পশ্চিম ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল না, আরও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাস করত।

৩. পরিবেশগত অভিযোজনের প্রমাণ – প্রাণীটি কীভাবে ভিন্ন পরিবেশে টিকে ছিল, তার আন্দাজ পাওয়া গেছে। গবেষক দল এখন এই জীবাশ্মের গভীরতর বিশ্লেষণ এবং একই স্তরে পাওয়া অন্যান্য জীবাশ্মের তুলনামূলক গবেষণা করছেন। তাদের আশা, এতে করে প্রাচীন সমুদ্রজগতের খাদ্যচক্র, পরিবেশ এবং অভিযোজন প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন ধারণা পাওয়া যাবে। এই আবিষ্কার আরও একবার প্রমাণ করল, পৃথিবীর অতীত এখনও বহু রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, যা এক একটি জীবাশ্মের হাত ধরে বেরিয়ে আসে।

সূত্র: “A new Eurhinosaurus (Ichthyosauria) species from the Lower Jurassic (Toarcian) of Mistelgau (Bavaria, Southern Germany)” by Gaël E. Spicher, Feiko Miedema, Jelle Heijne and Nicole Klein, 25 September 2025, Fossil Record.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + seventeen =