টাইটানে ব্যতিক্রমী রসায়ন

টাইটানে ব্যতিক্রমী রসায়ন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

শনি গ্রহের বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান আবারও বিজ্ঞানীদের চমকে দিল। এর বরফাচ্ছন্ন পৃষ্ঠে এমন এক রাসায়নিক ঘটনা ঘটেছে, যা রসায়নের মৌলিক নিয়ম বিরোধী।

চ্যালমার্স ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং নাসার যৌথ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, টাইটানের অতিশীতল পরিবেশে এমন কিছু পদার্থ স্থিতিশীলভাবে একত্রিত হতে পারে, যেগুলো সাধারণত একসঙ্গে মেশে না। সেখানে বিশেষ করে হাইড্রোজেন সায়ানাইড নামের একমেরু যৌগ মিথেন ও ইথেন-এর মতো অমেরু যৌগের সঙ্গে সহস্থিত কেলাস তৈরি করছে।এ একেবারে অপ্রত্যাশিত। কারণ প্রচলিত রসায়নের নিয়ম বলে— সর্বদা সদৃশ পদার্থই একে অপরকে দ্রবীভূত করতে পারে, অর্থাৎ মেরুযুক্ত ও অমেরু পদার্থ কখনো একসঙ্গে মেশে না। যেমন জল জলে মেশে, তেল তেলে মেশে কিন্তু তেলে জলে মিশ খায় না।

এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল পি এন এ এস-এ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আবিষ্কার শুধু টাইটানের অদ্ভুত ভূতত্ত্ব বোঝার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, জীবনের সূচনা কেমন পরিবেশে হতে পারে, সেই প্রশ্নের দিকেও আলোকপাত করেছে।

হাইড্রোজেন সায়ানাইড হলো অ্যামিনো অ্যাসিড ও নিউক্লিওবেস তৈরির একটি মৌলিক উপাদান,যা প্রোটিন ও ডি এন এ গঠনের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ, টাইটানের বরফে লুকিয়ে থাকতে পারে জীবনের আদি বীজ, এমন এক প্রক্রিয়া যা পৃথিবীর আদিকালে ঘটেছিল।

তাই এই অপ্রত্যাশিত যৌগ গঠন হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে, কীভাবে জীবনের ভিত্তি তৈরি হতে পারে এমন চরম ঠান্ডা পরিবেশেও।

গবেষণাটি শুরু হয়েছিল মূলত একটাই প্রশ্ন থেকে যে, টাইটানের বায়ুমণ্ডলে তৈরি হাইড্রোজেন সায়ানাইড পরে কোথায় যায়? এটি কি বরফে জমে থাকে, নাকি আশপাশের পদার্থের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ঘটায়?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি (জে পি এল)-এর বিজ্ঞানীরা মিথেন, ইথেন ও হাইড্রোজেন সায়ানাইডকে প্রায় ৯০ কেলভিন (-১৮০° সে) তাপমাত্রায় মিশিয়ে পরীক্ষা করেন। তাঁরা দেখতে পান, পদার্থগুলো গঠনগতভাবে অক্ষত থাকলেও পরস্পরের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে।

পরে চ্যালমার্সের অধ্যাপক মার্টিন রাহম-এর নেতৃত্বে কম্পিউটার সিমুলেশন করে প্রমাণ মেলে যে, এই পদার্থগুলো একসঙ্গে মিশে নতুন, স্থিতিশীল কঠিন কাঠামো তৈরি করছে, যা টাইটানের নিম্ন তাপমাত্রায় টিকে থাকতে সক্ষম।

এই ফলাফল রসায়নের এক মৌলিক নিয়মের ব্যত্যয় হলেও মার্টিন রাহম বলছেন, “এটি রসায়নের পুরো পাঠ্য বই কখনোই বদলে দেবে না, বরং প্রমাণ করবে বিজ্ঞানে কোনোকিছুই পরম বা চরম নয়। সেখানে সীমারেখা ভাঙার সুযোগ সবসময় থাকে।”

নাসার ড্রাগনফ্লাই নামক মহাকাশ সন্ধায়ক ২০২৮ সালে উৎক্ষেপিত হবে এবং ২০৩৪ সালে সেটি টাইটানে পৌঁছাবে। এই অভিযানের লক্ষ্য হলো জীবনের পূর্ববর্তী কালের রসায়ন ও সম্ভাব্য জীবনের চিহ্ন অনুসন্ধান করা।

টাইটানের এই চমৎকার আবিষ্কার থেকে মনে হয়, জীবনের বীজ শুধু পৃথিবীর উষ্ণ সমুদ্রেই নয়, বরফে ঢাকা এক দূরবর্তী গ্রহেও অঙ্কুরিত হতে পারে।

 

সূত্র: “Hydrogen cyanide and hydrocarbons mix on Titan” by Fernando Izquierdo-Ruiz, Martin Rahm,et.al;(23.07.2025), Proceedings of the National Academy of Sciences.

DOI: 10.1073/pnas.2507522122

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × two =