স্যর জিওফ্রে ইনগ্রাম টেলর (১৮৮৬-১৯৭৫) ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ এবং গণিতবিদ যিনি তরল গতিবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন । তাঁর কর্মজীবন জুড়ে টেলর যুগান্তকারী গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন উদ্ভাবনী গাণিতিক মডেল তৈরি করেছেন যা তরলপ্রবাহ এবং তাদের আচরণ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়িয়েছে।
জিওফ্রে টেলর ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে বেড়ে ওঠেন। অল্প বয়স থেকেই, তিনি ফ্লুইড বলবিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়ে গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে অবিশ্বাস্য দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। সেখানে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের উপর তিনি একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিলেন। নিজেকে গণিত এবং পদার্থবিদ্যার জগতে নিমজ্জিত করেছিলেন। পাঠ্যপুস্তক এবং বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র ঢেলে সাজিয়ে লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছেন জ্ঞানকে প্রসারিত করার জন্য। জ্ঞানের প্রতি তাঁর অদম্য তৃষ্ণা তাঁকে তার সমবয়সীদের থেকে আলাদা করেছিল । স্নাতক পর্যায়ের অধ্যয়নের পর টেলর কেমব্রিজেরই ট্রিনিটি কলেজ থেকে পিএইচ ডি সম্পন্ন করেন। গণিতে তার ডক্টরাল গবেষণার বিষয় ছিল স্থিতিস্থাপক পদার্থে তরঙ্গ এবং স্পন্দনের আচরণ। এ গবেষণা কাঠামোর গতিশীল বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই মৌলিক কাজটি তরলগতিবিদ্যার পরবর্তী যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ডক্টরেট ছাত্র থাকাকালীন, টেলরের উজ্জ্বলতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা তাঁর উপদেষ্টা এবং সহকর্মীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিল। গণিতের ক্ষেত্রে জ্ঞানের সীমানাকে দ্রুত প্রসারিত করার জন্য তাঁর গবেষণাপত্রগুলি বিস্ময় ও প্রশংসা জাগিয়েছিল। জটিল সমস্যাগুলিকে সহজে মোকাবেলা করার এবং সুচারু সমাধান করার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ ছিল। গণিতেজগতের গভীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে তিনি ফ্লুইড গতিবিদ্যার প্রতি ক্রমশ মুগ্ধ হচ্ছিলেন। তিনি এই ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখেছিলেন এবং তরল আচরণের রহস্য উদঘাটনে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। অদম্য কৌতূহল এবং জ্ঞানের নিরলস সাধনা তাঁকে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এবং যুগান্তকারী গাণিতিক মডেল তৈরি করতে প্রণোদিত করেছিল। ফ্লুইড মেকানিক্সের ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান সাফল্য এসেছিল অশান্ত দশার (Turbulence) ধারণাটির বিকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে। তিনি ল্যামিনার (সমান্তরাল) থেকে অশান্ত প্রবাহে রূপান্তর নিয়ে অন্বেষণ করেন এবং অশান্ত দশার নির্মাণের ইট (বিল্ডিং ব্লক) হিসাবে “এডিস”-এর (ঘূর্ণিপাক) ধারণাটি চালু করেন। অশান্ত দশাকে অধ্যয়ন করার জন্য টেলর পরিমাণগত পরিমার্গর (quantitative approach) ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন, আজ পর্যন্ত যা প্রভাবশালী রয়েছে। অশান্ত দশা বিষয়ে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা শুধুমাত্র ফ্লুইড গতিবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের বোঝার পথেই উন্নতি করেনি, উপরন্তু বিভিন্ন শিল্পে এর ব্যাবহারিক প্রয়োগও ঘটিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর কাজ বিমানের দক্ষতর ডানার নকশা বানানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যা ড্র্যাগ কমিয়ে এনে জ্বালানি-দক্ষতা বাড়ায়। উপরন্তু, অশান্ত দশা সম্পর্কে টেলরের অন্তর্দৃষ্টি ইঞ্জিনিয়ারদের পাইপলাইন এবং জল বন্টন ব্যবস্থার কর্মক্ষমতাকে কাম্য মাত্রায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, পরবর্তীকালে যা থেকে আরও নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী অবকাঠামোর উদ্ভব ঘটে। টেলরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ‘টেলর অস্থিরতা তত্ত্বে’র বিকাশ। পরীক্ষামূলক তদন্ত এবং গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে, তিনি এমন অবস্থার ব্যাখ্যা করেছিলেন যেগুলির অধীনে ফ্লুইডগুলি অস্থির হয়ে ওঠে, যা থেকে জটিল নিদর্শন এবং কাঠামো গঠনের উদ্ভব হয়। এই কাজটি জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা এবং ভূপদার্থবিদ্যা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল । এটি নক্ষত্রের গঠন এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ মেরুমজ্জার আচরণ প্রভৃতি মতো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছিল। তদুপরি, অস্থিরতা এবং প্যাটার্ন গঠনের উপর টেলরের গবেষণা ফ্লুইড রাজ্যের বাইরে প্রসারিত। অস্থিরতার অন্তর্নিহিত নীতিগুলি বিষয়ে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োগ ঘটেছে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া থেকে জৈবিক সিস্টেম পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্যাটার্ন গঠনের পিছনের প্রক্রিয়াগুলিকে অনুধাবনের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে নতুন নতুন উপকরণের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন । শুধু তাই নয়, দক্ষ ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থার ডিজাইন এবং জটিল জৈবিক কাঠামোর বিকাশেও অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সাহায্য করেছে। টেলরের কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান গণিতবিদ ড. ক্যাথরিন জনসন বিমানের চারপাশে ফ্লুইড প্রবাহের অনুকরণের জন্য উদ্ভাবনী গণনামূলক পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে তা নকশা তৈরির প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে এয়ারোডাইনামিক কর্মক্ষমতা উন্নত করেছিল। আজ, টেলরের উত্তরাধিকার কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্যার জিওফ্রে টেলর ফেলোশিপের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি তরল গতিবিদ্যার পুরোভাগে কাজ-করা অসামান্য তরুণ গবেষকদের সাহায্য করছে । তাঁর যুগান্তকারী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ টেলর কর্মজীবন জুড়ে অসংখ্য সম্মান লাভ করেছেন। অশান্ত প্রবাহের অস্থিরতা বিষয়ে তার অগ্রণী কাজের জন্য তিনি ১৯৯২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে মর্যাদাপূর্ণ উলফ পুরস্কারে ভূষিত হন। বিশ্বের জটিল ঘটনাসমূহকে গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে চলেছে টেলরের গবেষণা।