টেন্ট শুঁয়োপোকার অদ্ভুত জীবনচক্র

টেন্ট শুঁয়োপোকার অদ্ভুত জীবনচক্র

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ আগষ্ট, ২০২৫

উজ্জ্বল কমলা-কালো দাগযুক্ত লোমশ দেহবিশিষ্ট পশ্চিমি টেন্ট শুঁয়োপোকা (Malacosoma californicum) এক লেপিডোপ্টেরান প্রজাতির লার্ভা। উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সময় এগুলিকে অনেক পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। আবার পরিমাণ কমে গেলে এগুলি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এবং ল্যান্ড অ্যান্ড ফুড সিস্টেমস অনুষদের অধ্যাপক জুডিথ মায়ার্সের কাছে এই প্রজাতি একটি দীর্ঘস্থায়ী জনসংখ্যাগত গবেষণার মডেল। সদ্য প্রকাশিত তাঁর গবেষণা ৫০ বছরের তথ্যসমষ্টির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। সেখানে বিশ্লেষিত হয়েছে এদের আচরণবিধি, জনসংখ্যা চক্র এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধী অভিযোজন কৌশল। এদের ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় সর্বত্র পাওয়া যায় , ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপ ও দক্ষিণ গাল্ফ দ্বীপপুঞ্জে বিশেষ ঘন জনসংখ্যায়। তবে এদের বিস্তার আরও অনেক দূর অবধি – প্রায় ম্যানিটোবা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত। জীবন ধারণ ও বাড়বৃদ্ধির জন্য এরা Alnus rubra (লাল অ্যাল্ডার) এবং বিভিন্ন ফলগাছের উপর নির্ভরশীল। এপ্রিল মাসে ডিম ফুটে বের হয় লার্ভা, যা সম্মিলিতভাবে রেশমি তাঁবু তৈরি করে। এই তাঁবু উষ্ণতা ধরে রাখতে এবং শিকারীদের আক্রমণ থেকে এদের আংশিক সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে। জুনের শুরুতে লার্ভা সেই তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এসে বেড়া, গাছের কাণ্ড, দেওয়াল প্রভৃতি খাড়া কাঠামো খুঁজে নেয়। এখানে তারা পিউপা পর্যায়ে প্রবেশ করে। এই পর্যয়ে তাদের ঘনবিন্যস্ত সমাবেশ অনেক সময় স্থানীয় কৃষি ও পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উচ্চ ঘনত্বে তারা গাছের পাতা একেবারে সাফ করে দিতে পারে। ফলে গাছের সালোকসংশ্লেষণ কার্যকারিতা হ্রাস পায়, ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন ২০১২ সালে সল্ট স্প্রিং দ্বীপে এদের তীব্র প্রাদুর্ভাবের কারণে স্থানীয় আপেল উৎসব বাতিল হয়ে যায়। অধিকাংশ শিকারী প্রাণীর কাছে এরা আদপে অখাদ্য। এমনও তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে যে একটা ঘোড়া এই লার্ভা খেয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মায়ার্সের দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এদের জনসংখ্যার উত্থান-পতনের মূল নিয়ন্ত্রক হল একটি প্রজাতি-নির্দিষ্ট ব্যাকুলোভাইরাস। জনসংখ্যা উচ্চঘনত্বে পৌঁছালে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ফলে এদের ব্যাপক হারে মৃত্যু হয়। সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেনি কোরির সঙ্গে যৌথ গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে যে, এদের প্রাদুর্ভাব দ্বীপ ও মূলভূমি উভয় এলাকায় একই সময়ে ঘটে। কিছু স্ত্রী মথ পূর্ববর্তী বিলুপ্ত অঞ্চলে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে ডিম পাড়ে। এ হল অধি-জনসংখ্যা গতিশীলতার (মেটাপপুলেশন ডায়নামিক্স) একটি দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন স্থানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃক্রিয়া এবং পরিবেশগত গতিশীলতা একটি বৃহত্তর অঞ্চলের মধ্যে এক অধি -জনসংখ্যা (মেটাপপুলেশন) তৈরি করে। এই গতিশীলতা মূলত প্রজাতিগুলির বিস্তার, বিলুপ্তি এবং নতুন অঞ্চলে বসতি স্থাপন দ্বারা চালিত হয়। পঞ্চাশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের কোনো প্রভাব অন্তত এদের জনসংখ্যায় পড়েনি। ঠান্ডা আবহাওয়ায় সূর্যালোক গ্রহণ এবং উষ্ণ পরিবেশে তাঁবুর ছায়ায় থাকা – এভাবেই চরম তাপমাত্রার হাত থেকে এরা নিজেদের রক্ষা করে। প্রজাতিটি নিয়মিত একটি ৬-৮ বছরের জনসংখ্যা চক্র প্রদর্শন করে। ২০২৩ সালে গালিয়ানো দ্বীপ ও অন্যান্য গাল্ফ দ্বীপপুঞ্জ, এবং ওয়েস্টহ্যাম দ্বীপে এদের সর্বশেষ বিশাল প্রাদুর্ভাব নথিবদ্ধ রয়েছে। পরের বছরে এদের জনসংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে আসে। এপ্রিল মাসে ক্ষুদ্র লার্ভা ও নতুন তাঁবুর উপস্থিতি থেকে চক্রের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক মডেল অনুযায়ী তিন বছর পর্যন্ত এই পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। প্রাকৃতিকভাবে এদের প্রধান নিয়ন্ত্রক ভাইরাস। তবে, কৃষি পর্যায়ে শীতকালে ডিমের স্তূপ অপসারণ বা বসন্তকালে তাঁবু ছেঁটে ফেলাও বেশ কার্যকর। বাণিজ্যিকভাবে, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাসিলাস থুরিংয়েনসিস কুরস্টাকি প্রয়োগ সবচেয়ে কার্যকর। পশ্চিমি টেন্ট শুঁয়োপোকার জনসংখ্যাগত আচরণ, তাপমাত্রা অভিযোজন এবং প্রাকৃতিক রোগপ্রবণতা এই প্রজাতিকে জনসংখ্যা গতিবিদ্যা, পোকামাকড়ের বাস্তুতন্ত্র ও রোগ-পোষণকারী সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী গবেষণা মডেল করে তুলেছে। এর চক্রাকার প্রকৃতি শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল মেটানো নয়, কৃষি ও বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিকতা বহন করে।

সূত্র : Long-term population dynamics of western tent caterpillars: History, trends and causes of cycles by Judith H. Myers, et.al ; Journal of Animal Ecology (14 July, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × five =