ট্যুরিং টেস্টের দিন ফুরিয়েছে?

ট্যুরিং টেস্টের দিন ফুরিয়েছে?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

একসময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষ মাপার একমাত্র মানদণ্ড ছিল ট্যুরিং টেস্ট। ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান ট্যুরিং ১৯৫০ সালে এই ধারণাটি দেন। যদি একটি মেশিন কথোপকথনের মাধ্যমে একজন মানুষকে এমনভাবে ধোঁকা দিতে পারে যে মানুষটি বুঝতেই না পারে এটি একটি যন্ত্র, তবেই ধরে নেওয়া হত সেই মেশিনেরও মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা আছে।

কিন্তু ৭৫ বছর পেরিয়ে এসে আজকের বাস্তবতায় এই পরীক্ষা অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। আজকের চ্যাট জিপিটির মতো ভাষা মডেল সহজেই ট্যুরিং টেস্ট উতরে যায়। তাহলে কি এখন এর কোনো প্রয়োজনই নেই? এ প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানেই সম্প্রতি ২ অক্টোবর লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে আয়োজিত হয় এক বিশেষ আলোচনা সভা। সেখানে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা অংশ নেন। এই বিশেষ সভায় উপস্থিত বহু গবেষক বলেন, ট্যুরিং টেস্টকে এখন বিদায় জানানোর সময় এসেছে। তাঁদের মতে, এখন নতুন করে ভাবা দরকার যে কী ধরনের কৃবু ( কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা )সমাজের জন্য উপকারী এবং নিরাপদ হতে পারে।

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী অনিল শেঠ বলেন, “আসুন আগে ঠিক করি আমরা কী ধরনের কৃ বু চাই, তারপর তার জন্য পরীক্ষার পদ্ধতি বানাই।” তাঁর মতে, কল্পিত “এ জি আই” (আর্টিফিসিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স) অর্থাৎ মানুষের সমান বুদ্ধিসম্পন্ন যন্ত্র তৈরি করার প্রতিযোগিতা আমাদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করছে। আসলে দরকার এমন প্রযুক্তি, যা সমাজের কাজেও লাগবে এবং নিরাপদও হবে।

সভায় নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যারি মার্কাস বলেন, আপাতত এ জি আই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ডিপ মাইন্ডের তৈরি আলফাফোল্ড মডেল একক উদ্দেশ্যে তৈরি, যা প্রোটিন গঠনের পূর্বাভাস দিতে পারে, কিন্তু কবিতা লিখতে পারে না। অর্থাৎ, একেকটি কৃবু একেকটি ক্ষেত্রে দক্ষ, সর্বক্ষেত্রে তার সমান বুদ্ধিমত্তা থাকা সম্ভব নয়।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারা ডিলন মনে করিয়ে দেন, অ্যালান ট্যুরিং আসলে কখনোই “ইমিটেশন গেম” বা অনুকরণ পরীক্ষাটিকে বাস্তব মাপকাঠি হিসেবে ভাবেননি। এ ছিল মেশিন কি আদৌ ভাবতে পারে কিনা, আর কতটা ভাবতে পারে, সেই দার্শনিক প্রশ্নের এক বুদ্ধিদীপ্ত খেলা।

আজকের চ্যাট জিপিটি প্রভৃতি বৃহৎ ভাষা মডেল (এল এল এম) অনায়াসে মানুষের মতো উত্তর দিতে পারে, ইন্টারনেটের বিপুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে টেক্সট তৈরি করতে পারে এবং কথোপকথনে মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম। কিন্তু অনুকরণ মানেই তো অনুধাবন নয়। মার্কাস বলেন, যখন তাদের চেনা-জানা ক্ষেত্রের বাইরের প্রশ্ন করা হয়, তখনই দেখা যায় সীমাবদ্ধতা। যেমন, অনেক মডেল হাতির শরীরের অঙ্গ চেনাতে ভুল করে, কিংবা ঘড়ির কাঁটা সঠিক স্থানে আঁকতে পারে না।

তথাপি কৃবুর অগ্রগতির হার এতটাই দ্রুত যে,এটি ভাবতে বাধ্য করছে যন্ত্র কি সত্যিই একদিন মানুষের বুদ্ধির সমকক্ষ হবে? তাই বিজ্ঞানীরা এখন আরও কঠিন ও বহুমাত্রিক পরীক্ষা তৈরি করছেন, (যেমন ARC-AGI-2) যা মেশিনের অভিযোজন ক্ষমতা যাচাই করবে।

 

তবে এখনও পর্যন্ত গবেষকরা একমত হতে পারেন নি যে, কোন পরীক্ষার মাধ্যমে মেশিনকে “সার্বিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন” বলা যাবে। তাই অনেকের মতে, এখন ট্যুরিং টেস্টের বদলে আমাদের প্রয়োজন এমন মূল্যায়ন, যা নিরাপদ, বাস্তবমুখী এবং মানবকল্যাণে সহায়ক কৃবু গঠনে সহায়ক।

 

সূত্র : AI language models killed the Turing test: do we even need a replacement? by Elizabeth Gibney,published in journal ‘Nature’,(20.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =