অভিভাষণ এই শতাব্দীর অন্যতম একটি সমস্যা। আধুনিক পৃথিবীর জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন ও সীমারেখা যুক্ত দেশ স্থাপন অভিভাষণ সমস্যায় জর্জরিত করেছে পৃথিবীকে। আমরা দেখেছি শরণার্থী ক্যাম্প। ৪৭ বা ৭১ এর বাংলাদেশ- ভারতে নয় কেবল, মেক্সিকো বর্ডারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলে দেওয়া গ্রেট মেক্সিকো ওয়াল, মায়ানমারে, অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্যালেস্টাইন – ইজরায়েল- উদাহরণ বাড়তে থাকবে। রাজনৈতিক ভয় ছাড়াও বিশ্বায়িত পৃথিবীর ব্যবস্থার কারণেই আছে অভিভাষণ- ঘর ছাড়ার দল। বস্তুত বিশ্বায়িত পৃথিবীর মানুষ একার্থে ঘরছাড়াই- লেখাপড়া, জীবন জীবিকা এসবের জন্য একালের মানুষ ক্রমাগত ঘর ছেড়ে ছুটে চলেছে। প্রসঙ্গত এবছর অভিভাষী মানুষের যন্ত্রণার আখ্যান অধ্যাপক ঔপন্যাসিক আব্দুল রাজাক ঘুর্ণাকে এনে দিয়েছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। অভিভাষনের চমৎকার একটি প্রতিশব্দ হতে পারে ঠাঁইনাড়া। কিন্তু বিজ্ঞানের পত্রিকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সাহিত্যের কথা কেন?
ধরুন যদি এই বিশাল মহাকাশে, ব্রক্ষ্মাণ্ডে পাওয়া যায় কোনো ঠাঁইনাড়া গ্রহ, গ্রহানু বা অমন কিছু একটা মহাজাগতিক বস্তু? ধাক্কা খেয়ে কিংবা মহাকাশের জ্যোতিঃপদার্থর্বিজ্ঞানের নিয়মেই যার জন্ম।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমনই একটি পাথরখণ্ডের হদিশ পেয়েছেন বছর পাঁচেক আগে ২০১৬ সালে। মহাকাশে গ্রহ গ্রহাণুর তুলনায় ক্ষুদ্র একটি পদার্থ- একটি পাথর খণ্ডমাত্র। যার দৈর্ঘ্য মাত্র ১৬৫ ফুট। বস্তুটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কামোওয়ালেওয়া’- বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় টলমলে মহাজাগতিক বস্তু। নামটি হাওয়াইয়ান। কারণ ২০১৬ সালে হাওয়াইয়ের ‘প্যান স্টার্স ১’ টেলিস্কোপে প্রথম ধরা দেয় বস্তুটি। আরো চমকের কথা এই যে, পাথরখন্ডটি ঠাঁই নিয়েছে পৃথিবীরই কাছ ঘেঁসে। পৃথিবী থেকে কমপক্ষে ৯০ লক্ষ মাইল ও সর্বোচ্চ আড়াই কোটি মাইল দূরত্ব বজায় রেখেছে পাথরখণ্ডটি। তবে এটি কিন্তু পৃথিবীকে আবর্তন করে না, করে সূর্য কে- সূর্যের সাথের অভিকর্ষজ বলের যোগ এটির। এর কক্ষপথের আবর্তনের হিসেব কষে দেখা গেছে প্রায় এক শতাব্দী ধরে পাথরখণ্ডটি পৃথিবীকে অনুসরণ করছে। আগামী কয়েক শতাব্দী অনুসরণ চলতে থাকবে।
এখন প্রশ্ন- এলো কোত্থেকে এই কামোওয়ালেওয়া? মুস্কিল হচ্ছে কেবল টেলিস্কোপ দেখে এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয় ভারি শক্ত। তাছাড়াও ছোটো আকারের পাথরখণ্ডটির মাঝে মাঝেই ছায়ায় আড়াল হওয়ার স্বভাব আছে। তবে গত বৃহস্পতিবার (১১ই নভেম্বর, ২০২১) কমিউনিকেশানস আর্থ অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার শিক্ষার্থী বেঞ্জামিন শার্কি ও গবেষক দল প্রশ্নটির রহস্যভেদের উত্তর পাওয়ার দাবি করেছেন।
গোড়াতে মনে করা হতো গ্রহাণুতে সচরাচর যে ধরনের খনিজ পাওয়া যায়, তেমন উপাদানই বুঝি পাওয়া যাবে কামোওলেওয়াতে। কিন্তু ২০১৭ র এপ্রিলে পৃথিবী যখন কামোওয়ালেওয়া এবং সূর্যের মাঝামাঝি চলে আসে পাথরখণ্ডটি তখন উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়। অ্যারিজোনায় দুটি টেলিস্কোপে নজর রেখে প্রতিফলিত আলোয় পাথরখণ্ডটির খনিজ উপাদান বোঝার চেষ্টা করেন। প্রথমে সিলিকেট নামের একটি খনিজ নজরে আসে। এই খনিজটি সৌরজগতের যেকোনো পাথুরে বস্তুতেই দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী পর্যবেক্ষণে দেখা যায় কামোওয়ালেওয়ার সিলিকেট গুলো দেখতে অনেকটা চাঁদে পাওয়া সিলিকেটের মতো। এ আবিষ্কারে বেঞ্জামিন একই সাথে উত্তেজিত ও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। গঠন ও কক্ষপথ দেখে বেঞ্জামিনদের অনুমান কামোওয়ালেওয়া চাঁদেরই একটি খণ্ড। অতীত কোনো কালে হয়তো উল্কার আঘাতে খসে ঠাঁইনাড়া হয়ে আশ্রয় নিয়েছে পৃথিবী ঘেঁসে। তবে যেহেতু এর অভিকর্ষজ টান সূর্যের সাথে তাই একে চাঁদের মতো পৃথিবীর আর একটি উপগ্রহ/ বা উপপাথরখণ্ড বলা যাবে না। পৃথিবী উধাও হলেও সূর্যের অভিকর্ষজ টানে পাথরখণ্ড ঘুরতে থাকবে সূর্যের চারপাশে।
তবে খনিজ উপাদানের মিলের ব্যাপারটি কাকতালীয়ও হতে পারে। তাই কামোওয়ালেওয়ার উৎপত্তি সম্পর্কে দেওয়া তত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্য। হতে পারে এটি একটি গ্রহানু, যার উপাদানের সাথে চাঁদের উপাদানের মিল রয়েছে, বা হতে পারে কোনো গ্রহানু থেকে খসে পড়া খণ্ড। বেঞ্জামিনদের অনুমানেরর পাল্লা ভারি অবশ্য ‘চাঁদ থেকেই খসে পড়া’তে। তাছাড়াও কামোওয়ালেওয়া কেবল একা নয়, আরো এমন তিনটি বস্তুর কক্ষপথ জানাবোঝার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানীদের। হয়তো চারটি বস্তুর উৎপত্তি একই ঘটনা থেকে। নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ অবশ্য হাতে নেই জ্যোতিঃপদার্থবিদদের।
এ বিষয়ে তাই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী পল বার্ন বলেছেন, নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নভোযান পাঠানো। ইতিমধ্যেই চীনের একটি নভোযান অভিযান শেষে ফিরতি পথে পাথরখণ্ডটিতে অবতারণের পরিকল্পনা করছে- সফল হলে তা হতে হতেও এই দশকের শেষ দিক হয়ে যাবে৷ সেসময় পর্যন্ত চাঁদ চ্যুত, ঠাঁইনাড়া পাথরখন্ড হিসেবেই পরিচিতি কামোওয়ালেওয়ার।