
বাঁহাতের দস্তানা ডান হাতে লাগে না। কারণ এরা একে অপরের দর্পণ-বিম্ব। এই কাইরালিটি ধর্ম (অপ্রতিসমতা) জীববিজ্ঞান আর রসায়নের এক মূল নীতি। প্রকৃতিতে বেশির ভাগ ডিএনএ সূত্র দক্ষিণাবর্তী, কিন্তু বেশির ভাগ অ্যামিনো অ্যাসিড বামাবর্তী। কিন্তু আলোও একটা নির্দিষ্ট মুখে ঘুরে থাকতে পারে। আলো-কে বৃত্তাকারে অববর্তিত করলে (পোলারাইজ) সে যত সামনের দিকে এগোয় ততই তার তড়িৎক্ষেত্র ঘুরতে থাকে – হয় একটা বাম-মুখী কুণ্ডলী, নাহয় একটা ডান-মুখী কুণ্ডলীর চেহারা নিয়ে। অপ্রতিসম ধর্মযুক্ত (কাইরাল) পদার্থগুলো একেক ধরনের অববর্তিত আলোর সাপেক্ষে একেকরকম আচরণ করে। কোনো একটা পদার্থের ওপর বৃত্তাকারে অববর্তিত উজ্জ্বল আলো ফেলে কোন কুণ্ডলীটি কীভাবে শোষিত, প্রতিফলিত বা বিলম্বিত হয় তা মাপা যায়। এ থেকে পদার্থটি নিজে কোন মুখে ঘুরে আছে তা জানা সম্ভব। এইসব অতিসূক্ষ্ম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাহায্যে নিখুঁতভাবে অপ্রতিসমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল দীর্ঘদিনের এক কঠিন সমস্যা।
অবশেষে এর একটা সমাধান করা গেছে। বিজ্ঞানীরা ‘মেটাসারফেস’ (অধি-পৃষ্ঠতল) নামে এক ধরণের নতুন আলোক-কাঠামো গড়তে পেরেছেন। এগুলি হল অতিক্ষুদ্র মেটা-অ্যাটম (অধি-পরমাণু) দিয়ে গঠিত এমন এক দ্বি-মাত্রিক ল্যাটিস (সুপ্রতিসম জাফরি জাতীয় গঠন) যা অনায়াসে তাদের অপ্রতিসমতা ধর্মের সুরে সুর মিলিয়ে নিতে পারে। একটি ল্যাটিসের মধ্যে অধি-পরমাণুগুলির অভিমুখ বদলে নিলে তা থেকে যে অধি-পৃষ্ঠ বেরিয়ে আসবে, অববর্তিত আলোর সঙ্গে তার আন্তঃক্রিয়া বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবেন। এই অভিনব কৌশলটি ডেটা এনক্রিপশন, জৈব পদার্থ শনাক্তকরণ আর নানাবিধ কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে কাজে লাগবে।
জার্মেনিয়াম আর ক্যালসিয়াম ডাই-ফ্লুওরাইড দিয়ে তৈরি এই অধি-পৃষ্ঠটিতে অধি-পরমাণুদের এমন এক পরিবর্তন-মাত্রা (গ্রেডিয়েন্ট) থাকে যাদের অভিমুখ একটি চিপ বরাবর ক্রমাগত বদলাতে থেকে। একদিকে এইসব অধি-পরমাণুর গড়ন আর কোণ, অন্যদিকে ল্যাটিসের সুপ্রতিসমতা, সবই একযোগে ক্রিয়া করে, আর তারই সুরে সুর মিলিয়ে অববর্তিত আলোর প্রতি অধি-পৃষ্ঠর সাড়া বদলাতে থাকে।
ধারণাটি ঠিক কিনা তা যাচাই করবার জন্য একটি পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দুটি আলাদা বিম্বকে একটি অধি-পৃষ্ঠর উপর একই সঙ্গে সংকেতবদ্ধ করেন। অধিপৃষ্ঠটিকে আগেই তড়িৎচুম্বক বর্ণালীর অদৃশ্য মধ্য-অবলোহিত পাল্লার উপযোগী করে নেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিম্বটি ছিল একটি অস্ট্রেলীয় কাকাতুয়ার। সে-বিম্বের উপাত্তসমূহকে (যেগুলি পিক্সেলের প্রতিনিধি ) অধি-পরমাণুর আকারে সংকেতবদ্ধ করা হয় এবং অববর্তিত আলোর সাহায্যে সে-সংকেত উদ্ধার করা হয়। দ্বিতীয় বিম্বটিকে অধি-পরমাণুগুলির অভিমুখ দ্বারা এমনভাবে সংকেতবদ্ধ করা হয়, যাতে বৃত্তাকারে অববর্তিত আলোর সম্মুখীন হলে ওই অধি-পৃষ্ঠ থেকে ফুটে ওঠে সুপ্রসিদ্ধ সুইস ম্যাটারহর্ন পাহাড়ের ছবি। এ থেকে দেখা গেল, এমন এক দ্বিস্তর প্রতীকচিহ্ন নির্মাণ করা সম্ভব যা মানুষের চোখে অদৃশ্য। এর দৌলতে জাল করা, চোখে ধুলো দেওয়াকে ঠেকানো যাবে, সুরক্ষাসাধনেও এর প্রয়োগ ঘটবে। এনক্রিপশন তো বটেই, যেসব কোয়ান্টাম প্রযুক্তি কম্পিউটারে কাজ করার জন্য অববর্তিত আলোর উপর নির্ভরশীল, তারাও এ কৌশল কাজে লাগাতে পারবে। বড়ো বড়ো পৃষ্ঠতল বরাবর অপ্রতিসমতা ধর্ম-নির্ভর সাড়া কেমন জাগছে, এবার তার মানচিত্র আঁকার ক্ষমতা করায়ত্ত হওয়ায় জৈব পদার্থ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়াকেও হয়তো আরও মসৃণ করে তোলা যাবে। কোনটা ওষুধ আর কোনটা অধিবিষ, তা সহজেই চিনতে পারবে শরীর।
নেচার কমিউনিকেশন্স পত্রে প্রকাশিত এই অসাধারণ গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন হাতিস আলতগ-এর নেতৃত্বে লোসান-এর সুইস ফেডেরাল টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের বায়ো-ন্যানো-ফোটনিক সিস্টেম্স ল্যাবরেটরি আর অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা।
সূত্র: “Chirality encoding in resonant metasurfaces governed by lattice symmetries” by Ivan Sinev, Felix Ulrich Richter, Ivan Toftul, Nikita Glebov, Kirill Koshelev, Yongsop Hwang, David G. Lancaster, Yuri Kivshar and Hatice Altug, 2 July 2025, Nature Communications.
DOI: 10.1038/s41467-025-61221-2