
ডাইনোসর থেকে আধুনিক পাখিতে রূপান্তর এক দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফসল। একসময় মনে করা হতো এ বুঝি হঠাৎ ঘটে যাওয়া এক বিস্ময়কর ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে যে, এ ছিল অসংখ্য ছোট ছোট বিবর্তনাত্মক পরিবর্তনের সমষ্টি। আধুনিক পাখিরা একসময় থেরোপড নামের দ্বিপদ ডাইনোসরের একটি উপগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার মধ্যে ছিল ভয়ংকর টি.রেক্স ও ছোট কিন্তু চতুর ভেলোসিরাপ্টর।
প্রথম পরিচিত পাখি ছিল আর্কিওপটেরিক্স। এটি এক ধরনের সংযোগ সূত্র, যার পাখির মতো পালক ও ডানা থাকলেও মুখে ছিল সরীসৃপের মতো দাঁত ও লম্বা হাড়ের লেজ। অনেকদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটে গেছে। তারা ব্যাখ্যা হিসেবে ব্যবহার করতেন “আশাব্যঞ্জক দানব” নামক তত্ত্বটি। এ তত্ত্ব বলে যে, বড় জিনঘটিত পরিবর্তনের মাধ্যমে হঠাৎ করে নতুন প্রজাতির জন্ম হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, পাখির বৈশিষ্ট্যগুলো — যেমন পালক, ডানা, ও ওড়ার ক্ষমতা — গঠিত হয়েছে ধীরে ধীরে, পর্যায়ক্রমে ।
১৯৯০-এর দশকে চীন থেকে পাওয়া নতুন জীবাশ্মগুলোতে দেখা যায়, অনেক ডাইনোসরের পালক ছিল, যদিও তারা উড়তে পারত না। এই আবিষ্কার দেখায় যে, পালকের উৎপত্তি পাখির আগেই ডাইনোসরদের মধ্যেই ঘটেছিল। ফলে পাখির বিবর্তনের ইতিহাসে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। তাতে বলা হল, এ এক ধারাবাহিক রূপান্তর, যেখানে একটির পর একটি বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে।
স্টিফেন ব্রুসাট এবং তার সহকর্মীরা কোয়েলুরোসর নামের থেরোপডদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, পাখির বৈশিষ্ট্যগুলো একটির পর একটি ধাপে ধাপে উদ্ভূত হয়েছে, যেমন পালক, দ্বিপদ গতিচালনা, উইশবোন, জটিল পালক এবং পরে ডানা। এইসব পরিবর্তন একসাথে হঠাৎ হয়নি। বরং, পাখির বিকাশের পর এগুলি দ্রুত বিবর্তিত হতে থাকে এবং একসময় একটি সফল দেহগঠন ও পরিবেশগত অভিযোজনের কারণে বিস্ময়করভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
পাখির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের ছোট আকার। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পাখির পূর্বপুরুষরা অন্যান্য ডাইনোসরের মতো বড় হওয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করে। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে , আর্কিওপটেরিক্স- এর আগেই। এই ছোটো হয়ে যাওয়া পাখিদের জন্য উপকারী ছিল, কারণ ছোট প্রাণী সহজে গাছে চড়তে পারে, নতুন পরিবেশে বাস করতে পারে, পরে ওড়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
২০০৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আর্কহাট আবঝানোভ লক্ষ্য করেন, সরীসৃপের ভ্রূণ ও মুরগির ভ্রূণের মুখমণ্ডল প্রায় একইরকম। শিশু ডাইনোসরদের অনেকটা প্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের মতো দেখতে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ধারণা করেন, পাখিরা তাদের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে থেমে যাওয়ার মাধ্যমে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে — একে বলে পেডোমরফোসিস ।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী পরীক্ষায় দেখা যায়, ডাইনোসরের মুখ ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে এবং চোখ, মস্তিষ্ক ও ঠোঁট বড় হয়। এই শিশুসুলভ মুখের গঠন বলে দেয়, সম্ভবত পাখিরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বংশবিস্তারে সক্ষম হয়ে উঠত। এটি একটি কার্যকর বিবর্তনী কৌশল কারণ , এখানে নতুন কিছু তৈরি না হয়ে আগের বৈশিষ্ট্যগুলিই দীর্ঘায়িত হয়েছে।
পাখির ঠোঁট তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় অঙ্গ। ঠোঁটের মাধ্যমে তারা খাদ্য জোগাড় করে , বাসা বানায় এবং ছানাদের যত্ন নেয়। আবঝানোভ ও তার সহকর্মীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিছু নির্দিষ্ট জিনের ছোটখাটো পরিবর্তনের মাধ্যমে পাখির মুখমণ্ডল ডাইনোসরের মতো রূপ নিতে পারে।
তারা দেখেছেন, আধুনিক পাখির ঠোঁট গঠনে প্রিম্যাক্সিলারি হাড় দুটি একত্রিত হয়ে যায়, কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে এই দুটি হাড় আলাদা থাকে। পরীক্ষায় দেখা যায়, নির্দিষ্ট জিনের কার্যকারিতা রোধ করলে মুরগির ভ্রূণ ডাইনোসরের মতো মুখ গঠন করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, জিন ঘটিত বড় পরিবর্তন ছাড়াই ছোট ছোট নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবর্তন বড় কাঠামোগত রূপান্তর ঘটাতে পারে।
এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, বিবর্তন শুধুমাত্র বৃহৎ পরিব্যক্তি বা জিনের হঠাৎ পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। বরং, ছোট ছোট পরিবর্তনের সমন্বয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তৈরি হতে পারে। এটি “আশাব্যঞ্জক দানব” তত্ত্বকে অস্বীকার করে দেখায় যে, পাখির মতো নতুন এক শ্রেণির উদ্ভব একটি ক্রমাগত ও সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া।
পাখির বিবর্তনের এই গল্প কেবল একটি প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে প্রকৃতিতে বড় পরিবর্তন কিভাবে ধাপে ধাপে, ছোট ছোট পদক্ষেপে ঘটে যা একধরনের নীরব বিপ্লব। পাখিরা আসলে সেই ছোট ডাইনোসরদেরই উত্তরসূরি, যারা ধীরে ধীরে পালক গজিয়ে, চঞ্চুসদৃশ মুখ নিয়ে একসময় আকাশে উড়তে সাহস পেয়েছিল। অতএব, এই বিবর্তন ছিল দীর্ঘ, ধীর এবং আশ্চর্যজনকভাবে সূক্ষ্ম।
[26/07, 5:28 pm] Dr Supriya Nandi(Paleozoologist, ZSI) : শুভময়বাবু ডাইনোসর নিয়ে লেখাটা ভালো হয়েছে। অঙ্কিতাকে কিছু অধ্যাপক শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ও জন অষ্ট্রমের এই নিয়ে লেখা পড়াবেন। Idea বাড়বে।
[26/07, 6:00 pm] Subhamay Dutta: অনেক ধন্যবাদ। শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞানভাষের লেখা পড়েছেন।
[26/07, 6:18 pm] Prof Sankar Chatterjee , Honorary Prof of Geology, TexasTech University, Lubbock : অঙ্কিতার ডাইনোসর নিয়ে লেখাটা মোটের ওপর ভালো হয়েছে। ওকে Protoavis নিয়ে কিছু article পড়াতে পারো তাহলে এই anatomy-র জায়গাগুলো আরো পরিষ্কার করে লিখতে পারবে।
[26/07, 6:20 pm] Subhamay Dutta: অনেক ধন্যবাদ স্যার। সুপ্রিয়াদিও আপনার লেখা পড়াতে বলেছেন।