ডানা মেলে গেল উড়ে

ডানা মেলে গেল উড়ে

অন্তরা পাল 
Posted on ১৬ আগষ্ট, ২০২১

শিলিগুড়ি শহরের বাবুপাড়ায় একটি শিশু নাইট হিরন বা নিশি বক বড় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়। এক ব্যক্তি সেটিকে প্রাথমিক পরিচর্যার পরে পরিবেশ সংস্থা ন্যাফের হাতে তুলে দেন। শিশু পাখিটির বা পায়ে আঘাত ছিল। পাখিটির বয়স খুব বেশি হলে ২০ দিন হবে এবং সে উড়তেও শেখেনি। মরল্লা , কাচকি , চাপলে মাছ আর চিকেন কিমা খাইয়ে বেশ সুস্থ সবল করে তোলা হয় পাখিটিকে। পায়ের আঘাত একেবারে নির্মূল না হলেও অনেকটা কম হতে থাকে। ৮-৯ দিনের মাথায় পাখিটি বেশ শক্ত পায়ে দাঁড়াতে ও হাঁটাচলা করতে শুরু করে। দুই ডানা মেলে ওড়ার চেষ্টা শুরু করে। প্রতিদিন একটু একটু করে পাখিটি সাইজেও বড় হতে থাকে ও শক্ত সমর্থ হয়ে ওঠে। ১২ দিনের মাথায় পাখিটিকে তুলে দেওয়া হয় বন দফতরের হাতে। উড়িয়ে দেওয়া হয় আকাশে।

নাম তার নিশি বক বা রাতচরা ( ইংরেজি ভাষায় Black-crownrd Heron ) মাঝারি আকারের বক প্রজাতির একটি পাখি । Scientific name – Nycticorax nycticorax । নামেও নিশি বক , স্বভাবেও নিশাচর এই পাখিরা । সন্ধ্যে নামার মুখে “ওয়াক – ওয়াক “ শব্দ তুলে , সাঁঝের আকাশে ডানায় ভর করে শুরু হয় তাদের রাতের দৈনন্দিন কার্যকলাপ । নাম নিশি বক হলেও অন্য সাধারন বক প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে এদের চেহারার গড়নে কিছু পার্থক্য রয়েছে । নিশি বকদের চেহারায় রয়েছে বেশ রাজকীয় ভাব । এদের মাথা ও পিঠ চকচকে কালো আর দেহের বাকি অংশ ডানা পর্যন্ত ধূসর । দেহের নিচের অংশে থেকে ধূসর আভার রেশ ছড়িয়ে রয়েছে । চোখ দুটি বড় ও লাল বর্ণের ।আর কমলা – হলুদ পা জোড়া আর হলদেটে কালো ঠোঁট । স্ত্রী – পুরুষ উভয়েই একই রকম দেখতে হলেও পুরুষ পাখিরা আকারে একটু বড় । একটি পূর্ণ বয়স্ক নিশি বকের উচ্চতা ৫৮-৬৮ সেমি হয়ে থাকে । তবে শিশু নিশি বক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক দের চেহারা একেবারে আলাদা । বাদামী রং এর দেহের উপর স্পষ্ট সাদা ছিট ছিট দাগ এদের চেহারার প্রাধান বৈশিষ্ট্য । হঠাৎ এক নজরে দেখলে শিশু নাইট হিরন কে “ গো বক “ বলে ভুল হয় । এরা স্বভাবে বেশ শান্ত , লাল বর্ণের দুই চোখ দিয়ে স্থির দৃষ্টি শিকারের উপর নিক্ষেপ করে । এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে – ব্যাঙ , মাছ , ছোট সরীসৃপ , জলজ পোকা ও উদ্ভিদ ইত্যাদি ।
ইউরেশিয়া , আমেরিকা – আফ্রিকা ছাড়াও এই পাখিরা আমাদের ভারতে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে । সেই সংখ্যার নিরিখে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও এরা বেশ ভাল সংখ্যায় আছে । একসময় এই পাখিরা আমাদের দেশে এরা পরিযায়ী হয়ে উড়ে আসত । কিন্তু বিগত ১৫-২০ বছর হোল এই প্রজাতির পাখিরা আমাদের শিলিগুড়ির শহর ও শহরতলি সহ আশ –পাশের গ্রাম- গঞ্জের স্থায়ী প্রজাতি হিসেবে বসত শুরু করেছে । প্রতি বছর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের শহরের বট, পাকুড় , পিপুলের মতো বড় গাছগুলিতে বংশবিস্তারের জন্য বাসা তৈরি করে । সঙ্গী নির্বাচন থেকে শুরু করে , ডিম পাড়া, ডিম ফুটলে বাচ্চাদের বড় করিয়ে উড়তে শেখানো সবটুকুই এই শহরের ব্যস্ততম , জনবহুল এলাকার মধ্যে পাখিরা নিশ্চিন্তে সম্পন্ন করে । একটি একই গাছে হিরন গোত্রের পাখি ছাড়াও অন্য প্রজাতির পাখিরাও বাসা তৈরি করে । এই প্রজনন সময় কালে পাখিরা বিভিন্ন রকম ভাবে বিপদের সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে ঝড় – ঝাপটা , বাদলের দিনে বড় উঁচু গাছ থেকে শিশু পাখিদের মাটিতে পড়ে যাবার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এই রকম আহত , বিপদ্গ্রস্থ পাখিদের উদ্ধার করে পুনরায় সুস্থ করে তাদের উপযুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দেবার কাজ আমাদের হিমালয়ান নেচার এন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউণ্ডেশন বহু বছর ধরে করে চলেছে ।
গত ২২শে জুলাই’২০২১ এমনই একটি শিশু নাইট হিরন আমাদের শহরের বাবুপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাপি মৈত্র র বাড়ির বড় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয় । বাপি মৈত্রর বাড়ির লোক পাখিটি কে উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে পরিচর্চা করেন ও তারপর আমাদের সংস্থার সদস্যদের হাতে তুলে দেন । এরপর আমরা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি শিশু পাখিটির বা পায়ে আঘাত লেগেছে । পাখিটির বয়স খুব বেশি হলে .২০ দিন হবে এবং সে উড়তেও শেখেনি।
এই বয়সের যে কোন শিশু পাখিকে তার মা – বাবা খাবার সংগ্রহ করে মুখে মুখে খাওয়ায় ও নিরাপত্তা দিয়ে আগলে রাখে । তাই আমরাও কখনো পাখিটিকে কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়াল করি নি। নিয়ম করে পাখিটিকে আমাদের সংস্থার অফিসে নিয়ে আসা , আবার রাত হলে পাখিকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবার কাজটি নিয়ম করে করেছেন আমাদের সদস্য দেবজ্যোতি দে। শিশু পাখিটিকে টানা ১২ দিন ধরে আমাদের সদস্য- সদস্যারা সকলে মিলে নিয়মমাফিক তার পরিচর্চা করেন ও এই পাখির উপযোগী খাওয়া ( ছোট কুচো মাছ যেমন – মরল্লা , কাচকি , চাপলে ইত্যাদি ও চিকেন কিমা ) খাইয়ে বেশ সুস্থ সবল করে তোলেন ।সঠিক নিয়মে পরিচর্যার ফলে পায়ের আঘাত একেবারে নির্মূল না হলেও অনেকটা কম হতে থাকে । ৮-৯ দিনের মাথায় পাখিটি বেশ শক্ত পায়ে দাঁড়াতে ও হাঁটাচলা করতে শুরু করে । দুই ডানা মেলে ওড়ার চেষ্টা শুরু করে । প্রতিদিন একটু একটু করে পাখিটি সাইজেও বড় হতে থাকে ও শক্ত সমর্থ হয়ে ওঠে ।
আমাদের কাছে ১২ দিন থাকার পর পাখিটিকে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ করে তোলার জন্য , তার নিজস্ব উপযোগী পরিবেশে ফিরিয়ে দেবার জন্য ন্যাফের তরফ থেকে শিলিগুড়ি বেঙ্গল সাফারির কতৃপক্ষের হাতে ২রা আগস্ট’২০২১ তুলে দেওয়া হয়। বেঙ্গল সাফারি সম্পূর্ণ ভাবে এই দায়িত্ব যত্নসহকারে গ্রহণ করেছেন । পরবর্তীতে সংস্থার তরফ থেকে আমাদের অনিমেষদা প্রতিদিন তার খোঁজ – খবর রাখছেন ।
বর্ষার মরশুমে পাখিদের প্রজনন কালে আমাদের সকলের নিজস্ব এলাকার মধ্যে থাকা এই ধরনের বড় গাছগুলিতে নাইট হিরনের মতো বিভিন্ন বক , পানকৌড়ি , কাস্তেচরা দের পাখির বাসা থাকে । এই সময়টিতে আমরা সাধারণ মানুষ যদি সচেতন থাকি তবে এই ভাবে বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়া অনেক পাখির জীবন বাঁচিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ভূমিকা পালন করতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − 7 =