ডারউইনের প্রকৃতি প্রেম

ডারউইনের প্রকৃতি প্রেম

Posted on ৮ এপ্রিল, ২০১৯

আমাদের চারপাশে রয়েছে কত অসংখ্য রকমের জীবজন্তু আর উদ্ভিদ। সারা পৃথিবীর মাটি আর জলে গাছ-গাছড়া আর জীবজন্তু সাম্রাজ্যের যে বৈচিত্র্যময়তা রয়েছে, তা ভাবলে কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না ! এই রহস্যময়তা আমদেরকে একদিকে যেমন মুগ্ধ করে, অন্যদিকে ক’রে তোলে অন্তহীন কৌতূহলী। কী ক’রে সৃষ্টি হল এই এত লক্ষ-কোটি রকমফের প্রাণী আর গাছপালা ? পৃথিবীর জন্মের সময় থেকেই কী এই সব উদ্ভিদ প্রাণী ছিল ? পৃথিবীর বুকে কবে আর কী ভাবেই বা শুরু হয়েছিল জীবনের ? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ কখন এসেছে ? এই রকম সব প্রশ্ন হাজার হাজার বছর ধ’রে মানুষকে ভাবিয়েছে ! বিশ্বপ্রকৃতির এই বিপুল রহস্য সম্পর্কে উত্তর খুঁজেছে মানুষ ! কৌতূহলী করেছে ! আর এসবের কোনো সঠিক উত্তর না পেয়ে একসময় মানুষ ভেবেছে, তাহলে ‘ঈশ্বর’ ব’লে কিছু আছে, যার নির্দেশেই সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বপ্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র্যময়তা !

এই রকমই বেশ কিছু প্রশ্ন গিজগিজ করছিল তখন সেই ছেলেটির মাথাতেও। কতই বা তখন বয়স তার ! তেইশ বছর হতে তখনও মাস দুয়েক বাকি ! আর কিছুদিনের মধ্যেই সে একটি জাহাজে চ’ড়ে পৃথিবীর নানান দ্বীপ-জঙ্গল-প্রান্তর পরিভ্রমণে যাবে। এই সমুদ্র অভিযান ছিল একটি সরকারি অভিযানে, প্রকৃতিবিদ হিসেবে বিনা মাইনের একটি চাকরি। আমরা যার কথা বলছি, সেই তরুণ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর নাম চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) ।

‘এইচ.এম.এস বিগ্‌ল’ নামের পালতোলা জাহাজটি যাত্রা শুরু করল ২৭ ডিসেম্বর ১৮৩১ । ওই জাহাজ সুদূর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে নানান দ্বীপ আর জঙ্গলে পাড়ি দিয়েছে টানা পাঁচ বছর। সেই যাত্রাপথে ডারউইন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছেন বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র সব উদ্ভিদ আর প্রাণী সম্পদ। দেখেছেন মনোমুগ্ধকর প্রবাল দিয়ে তৈরি, সমুদ্রের ওপর জেগে ওঠা আস্ত একটা দ্বীপ ! কিংবা হাজার হাজার বছর ধ’রে সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ জমে সৃষ্টি হওয়া প্রবাল প্রাচীর – প্রকৃতির অপরূপ এক সৃষ্টি! তিনি লক্ষ্য করেছেন এক একটি দ্বীপে এক এক রকমের কচ্ছপের প্রজাতি ! নানা জাতের বিচিত্র সব পাখি, আলাদা আলাদা ঠোঁটের গড়ন, যাদের খাদ্যাভাস আলাদা আলাদা ! গ্যালাপাগোস দ্বীপে দেখেছেন সামুদ্রিক ইগুয়ানা ! তাদের অদ্ভুত আচরণ ! দেখেছেন নানান ধরনের গাছ-গাছড়া ! সংগ্রহ করেছেন সে’সব নমুনা ! ওইসব উদ্ভিদ প্রাণীর সৃষ্টি রহস্য আর বেঁচে থাকা সম্বন্ধগুলি দারুণভাবে কৌতূহলী ক’রে তুলল ডারউইনকে। নানান প্রশ্নে তোলপাড় হয়েছে তাঁর মন আর নিরন্তর উত্তর খুঁজেছে। জাহাজে ফিরে নোটবুকে লিখে রেখেছে সে’সব কিছু। এই অভিজ্ঞতা ডারউইনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তা আমরা পরে দেখব !

পরিভ্রমণ শেষে ডারউইন যখন ফিরে এল, মাথার মধ্যে তখন তাঁর অজস্র প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা। ওইসব উদ্ভিদ আর প্রাণীদের নানান প্রজাতিরা কীভাবে পৃথিবীতে উদ্ভব হয়েছে আর কীভাবেই বা টিকে থেকেছে – এই ব্যাপারগুলি বোঝার চেষ্টা করেছেন। বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, সে-সব নিয়েই তখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান ! আরও দীর্ঘ সময় ধ’রে বিচার বিবেচনা আর চিন্তাভাবনা ক’রে জনসমক্ষে আনলেন তাঁর সেই আইডিয়া ! সেই ভুবনবিখ্যাত তত্ত্ব, যা আমাদের ভাবনাকে প্রসারিত করেছে, এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে।

Darwin’s Tuatara swimming in oceans around Galapagos

সে’সব কথা জানার আগে এসো বোঝার চেষ্টা করি, কী করে আর কখন থেকে শুরু হয়েছিল প্রকৃতির প্রতি ডারউইনের ওই তীব্র আগ্রহ ? তা জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে ডারউইন যখন বেড়ে উঠছে, সেই সময়ে।

মাত্র আট বছর বয়সে মা-কে হারিয়েছে ডারউইন। বাবা আর দাদু দু’জনেই ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। যথেষ্ট বিত্তশালী ! তবে ডারউইনের স্কুলের পড়াশোনার মান ছিল খুব সাধারণ ! পড়াশোনায় আগ্রহও ছিল খুব কম ! ছোটো বয়স থেকেই স্কুল যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বনবাদাড় আর খালবিলের ধারে ঘুরে বেড়াত সে। সংগ্রহ ক’রে আনত নানান ধরণের পোকামাকড়। তারপর বাড়িতে নিয়ে এসে নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করত ওইসব পোকামাকড়দের ! এদিকে পড়াশোনায় মন নেই ব’লে, খুব দুশ্চিন্তায় পড়লেন বাবা ! যাই হোক, কোনো রকমে স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার পরে ছেলেকে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন বাবা !

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ডারউইনের এক দিক থেকে ভালোই হল। সেখানকার খোলামেলা জায়গায় দেদার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেল সে। একই সঙ্গে প্রকৃতিকে আরও কাছ থেকে নিবিড় ক’রে চেনার একটা সুযোগ পেল ! সেখানে গিয়ে একটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সদস্যও হয়েছে ! তবে যে কাজের জন্যে আসা সেই ডাক্তারি পড়তে ডারউইনের মোটেই ভালো লাগছে না ! বিশেষ করে অপারেশনের ক্লাসগুলি ছিল কাছে রীতিমতো আতঙ্কের ! আসলে তখনও ক্লোরোফর্ম আবিষ্কার হয়নি, তাই হাসপাতালের অপারেশন টেবিল, রোগীদের যন্ত্রণা-চিৎকার, রক্ত – সব কিছু মিলিয়ে সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ! শেষ পর্যন্ত এডিনবরায় দু’বছর কাটিয়ে মাঝপথে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে ডারউইন বাড়ি ফিরে এল !

ছেলেকে এরপর বাবা পাঠালেন চার্চের শিক্ষা নিতে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আঠারো বছর বয়স তখন। ধর্মযাজক হওয়ার পড়াশোনা মানে কেবল আচার অনুষ্ঠান, পুজোআচ্চা আর ধর্মের বই পড়া নয়। উদ্ভিদবিদ্যা ভূতত্ত্ববিদ্যা এসবও পড়তে হয় সেখানে। তাছাড়া পরীক্ষায় পাশ করতে হবে তবে ডিগ্রি মিলবে ! সেখানে গিয়েও ডারউইন ঘুরে বেড়ায় জলা, বিল আর বনেবাদাড়ে ! পশুপাখি, পোকামাকড় – এসবেই ওর তীব্র আগ্রহ ! প্রকৃতি যেন তাকে সব সময় হাতছানি দিয়ে ডাকে ! ডারউইনের প্রকৃতিপ্রেমের কথা কেমব্রিজে তার সহপাঠী আর অধ্যাপক মহলেও জেনে যায় ! কেমব্রিজের দু’জন তরুণ অধ্যাপক ডারউইনের অদম্য প্রকৃতিপ্রেমের বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। ডারউইনকে ভালো লেগে যায় ওই অধ্যাপকদের ! ওঁদের একজন হলেন উদ্ভিদবিদ জন স্টিভেন্স হেন্সলো। চার্লসকে সঙ্গে নিয়ে হেন্সলো মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন বনেবাদাড়ে। দারুণ যত্ন ক’রে তিনি ডারউইনকে চিনিয়ে দিতেন প্রতিটি গাছগাছালি, নাম-গোত্র। এমনকি, হেন্স নিজের ঘরেও মাঝে মাঝে ডারউইন’কে ডেকে পাঠাতেন আর ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো আড্ডা দিতেন ! একই সঙ্গে চলত ডারউইনের মনের কৌতূহল নিরসন করার চেষ্টা। এইভাবে ডারউইনের প্রকৃতিপ্রেমের উদ্দীপনার আঁচ আরও উসকে দেন হেন্সলো। অধ্যাপক হেন্সলো’ই ডারউইনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান প্রকৃতিবিদ ও অভিযাত্রী আলেকজান্ডার ফন হামবোল্টের লেখা একটি বই। এই বই প’ড়েই ডারউইনের সমুদ্র অভিযানের স্বপ্ন জারিত হতে থাকে ভেতরে ভেতরে ! জেগে ওঠে প্রকৃতির রহস্য সম্বন্ধে আরও প্রশ্ন !

অন্য আর একজন অধ্যাপক হলেন অ্যাডম সেজউইক। তিনি ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ। হাতে ধ’রে তিনি ডারউইন’কে চেনালেন বিভিন্ন রকম পাথর, প্রস্তরীভূত জীবাশ্মদের সম্বন্ধে। ভূতত্ত্ববিদ্যার এই শিক্ষা পরবর্তীকালে দারুণ কাজে আসে ডারউইনের। তাঁর চিন্তাভাবনা আর উপলব্ধির স্তরকে সমৃদ্ধ করেছিল। ডারউইন সে’কথা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ “Upon the whole three years which I spent at Cambridge were the most joyful in my life.”

Galapagos islands

আবার ফিরে আসি ডারউইনের বিগ্‌ল অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পরের কথায় ! সমুদ্র অভিযান থেকে ফিরে এসেছে যখন, ডারউইনের বয়স সাতাশ বছর। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হল ডারউইনের প্রথম বই – A Naturalist Voyage in the Beagle। ওই যাত্রাপথে মোট তিন বছর তিন মাস স্থলে আর আঠারো মাস কেটেছে সমুদ্রে ! প্রাণীবিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা আর নৃতত্ত্ববিদ্যার উপর আধারিত এই লেখা জাহাজে পরিভ্রমণ-কালের চিত্তাকর্ষক বিবরণ ! সেই সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলির অবস্থান উল্লেখও ! এই রচনার ছত্রে-ছত্রে ফুটে উঠেছে ডারউইনের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ! তবে তাঁর যুগান্তকারী ভাবনাপ্রসূত যে কাজ, তা প্রথম জনসমক্ষে আনতে ডারউইন সময় নিয়েছেন দীর্ঘ কুড়ি বছর ! ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর সেই জগৎবিখ্যাত বই The Origin of Species। একদম প্রথমে তাঁর সেই বইয়ের নাম ছিল On the Origin of Species by Means of Natural Selection ! প্রকাশের প্রথম দিনেই লন্ডন শহরে সাড়া ফেলে দিল এই বই। শুধু সাড়া ফেলাই নয়, উনিশ শতকের সামাজিক ভিত্তিকেই আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর এই বই ! এক দিনেই শেষ হ’য়ে গেল বইয়ের প্রথম সংস্করণ !

এরই পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞানী এবং চার্চের মানুষজন ডারউইনের কাজকে আমল দিতে চাননি। ডারউইনের ভাবনাকে ভুল ব’লে তীব্র কটাক্ষ করেছে ! শুধু ভুল ব’লেই ক্ষান্ত হলেন না তারা, ঠাট্টা বিদ্রুপ আর হাসির খোরাক ক’রে, ডারউইনকে বিদ্ধ করেছে বারে বারে !

কেন এই বিরোধিতা ? আসলে পৃথিবীতে নানান ধরনের জীবজন্তু কীভাবে এসেছে, সেকথা ডারউইনের আগে এইভাবে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে আর কেউ বলেনি। তিনিই প্রথম বললেন, লক্ষ-কোটি বছর ধ’রে তিলতিল ক’রে, নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে এসেছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। বললেন ‘Evolution’-এর কথা ! বাংলা তর্জমা করলে যা হয় – বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ। বিবর্তনের একটি তত্ত্বগত রূপ প্রথম পরিবেশন করেন ডারউইন’ই! সমস্ত সজীব বস্তু – পিঁপড়ে থেকে হাতি, সব কিছুই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভূত ! তারপর প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্যে প্রত্যেকেই চালিয়ে গেছে নিরন্তর লড়াই ! Struggle for Existance ! এ লড়াই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর লড়াই। পরিবেশ পরিমন্ডলের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লড়াই। যাকে আমরা বলে থাকি – জীবনযুদ্ধ। আর এই জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে টিকে থাকতে না পেরে লক্ষ-লক্ষ প্রজাতি অবলুপ্ত হ’য়ে গেছে পৃথিবী থেকে। উপযুক্ত যারা, খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে যারা, প্রকৃতি তাদের সহায়ক হয়েছে। টিকে থাকতে পেরেছে ওরা ! এটাই Survival of the fittest-এর মূল কথা। এই সমস্ত তত্ত্ব ডারউইন’ই আমাদের শুনিয়েছেন। তিনি এসব বলেছেন তাঁর The Origin of Species বইয়ে। ৬০০ পাতার যে বইটি তথ্য প্রমাণ যুক্তি আর বিবরণে ঠাসা।

 

বইয়ের একদম শেষে এসে ডারউইন লিখেছেন, “এই ভাবনা ও তত্ত্ব যদি গৃহীত হয় তাহলে তা হবে প্রকৃতির ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। উন্মোচিত হবে গবেষণার নতুন নতুন দিক। একই সঙ্গে মানুষের উৎস আর তাঁর ইতিহাসের ওপরে পড়বে অনেক সন্ধানী আলো’’।

Old monstrous land tortoise

কেমব্রিজের দু’জন অধ্যাপকের সঙ্গ যেমন ডারউইনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সেরকমই আরও কয়েকজন মানুষের কথা উল্লেখ করা দরকার। যাদের প্রভাব কোনো-না-কোনো ভাবে ডারউইনের জীবনকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল ! তাঁদের একজন হলেন ডারউইনের নিজের দাদু। তিনি একদিকে যেমন একজন নামজাদা ডাক্তার ছিলেন। তেমনই ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক এবং মুক্তচিন্তার একজন মানুষ ! ডারউইনের দাদু একজন নামী কবিও ছিলেন ! তাঁর অধিকাংশ কবিতার বিষয় ছিল ‘প্ল্যান্ট-সেক্স’ সংক্রান্ত ! “Would it be too bold to imagine, that all worm blooded animals have arisen from one living filament…?” ! এই যে বক্তব্য, তা ১৭৯৪ সালে জুনোমিয়া নামের একটি বইয়ে ডারউইনের দাদু’র লেখা ! অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, তাঁর দাদুর এরকম অগ্রগামী ভাবনা ডারউইনের চিন্তা ভাবনাকে নিঃসন্দেহে আলো দেখিয়েছিল !

থমাস ম্যাথুস (১৭৬৬-১৮৩৪) ছিলেন একজন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ! ১৭৯৭ সালে তাঁর লেখা একটি রচনা ‘On the Principle of Population’। জনসংখ্যার যে বৃদ্ধি, তুলনামূলক ভাবে তা মানুষের খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে অনেক দ্রুত ! আর যার পরিণতি হল অনাহার এবং অনাহার-জনিত মৃত্যু ! ম্যাথুসের এই লেখার কেন্দ্রীয় ভাবনাটি ডারউইনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী জাঁ বাপতিস্ত দ্য ল্যামার্ক, যিনি প্রথম প্রস্তাব করেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতির পরিবর্তন হয়। কিন্তু এর পেছনে কী কারণ বা কীভাবে তা ঘটে সেই আইডিয়াটি ছিল ভুল ! তবে ল্যামার্কের এই ভাবনা ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশনের তত্ত্বকে অনুপ্রাণিত করেছিল !

শুধু ইংল্যান্ডে নয়। আলোড়ন প’ড়ে গেল সমস্ত পৃথিবীতে। মানুষ খুঁজে পেল অপরাপর জীবজন্তুর মতন মানুষ প্রজাতির উদ্ভবের সূত্রটি। কেঁপে উঠল সারা দুনিয়া। এ যে সরাসরি বাইবেলকে অস্বীকার ! ঈশ্বরের দ্বারাই মানুষ বা অপরাপর জীবজন্তুর সৃষ্টি – প্রচলিত এই ধর্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ডারউইনের তত্ত্ব ! যা সরাসরি ধর্মদ্রোহিতার সামিল ! বলা বাহুল্য যে মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠল ডারউইন আর তাঁর তত্ত্ব।

পরে ১৮৭১ সালে, ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ নামের একটি বইয়ে, মানুষের উদ্ভব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডারউইন বলেছেন, বর্তমান সময়ের যে মানুষ আর বাঁদর – তারা সৃষ্টি হয়েছে একই পূর্বপুরুষ থেকে। ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ প্রকাশের পরে ডারউইনের ওপর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেল বহুগুণ। তাকে বিদ্রূপ ক’রে বাঁধা হল গান। নানান পত্রপত্রিকায় ছাপা হল ব্যঙ্গচিত্র ! ১৮৭৪ সালে লন্ডন স্কেচবুক পত্রিকায় ছাপা হল সে’রকমই একটি কার্টুন, যেখানে গা-ভর্তি লোম নিয়ে অবিকল বাঁদরের মতন দেখতে ডারউইন অন্য একটি বাঁদরের সঙ্গে আয়নায় মিল খুঁজছে। জীবদ্দশাতে তো বটেই, মৃত্যুর পরেও তাঁর বিবর্তনবাদ তথা প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটিকে মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। যা সত্য, তা সত্যই ! তাই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো ডারউইনের এই তত্ত্বকে হাজার আক্রমণেও নস্যাৎ করতে পারেনি কেউ।

Natural view in Galapagos

শুধু জীববিজ্ঞানীরাই নয়, ডারউইনের এই বই সমাজের নানান স্তরের আগ্রহী মানুষ এবং চিন্তাবিদরা পড়েছেন ! এখানে একটা কথা উল্লখ করি । ১৮৭৩ সালে বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী কাল মার্ক্স তাঁর প্রখ্যাত ‘ডাস ক্যাপিটেল’-এর প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় সংস্করণটির একটি কপি ডারউইনকে পাঠিয়েছিলেন। বইয়ের ওপর মার্ক্স লিখে দিয়েছিলেন ‘চার্লস ডারউইন’কে, তাঁর একজন একনিষ্ঠ ভক্তের নিবেদন। পরে ধন্যবাদ জানিয়ে মার্ক্স’কে ডারউইন একটি চিঠি লেখেন ! যার শেষ দুটি লাইন ছিল এইরকম – “আমাদের দু’জনের গবেষণার বিষয় আলাদা হলেও আমার স্থির বিশ্বাস, আমরা দু’জনেই আন্তরিকভাবে চাই জ্ঞানের প্রসার। আর আমাদের এই চাওয়া ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই মানবজাতির কল্যাণের পথকে ক’রে তুলবে সুগম”!

ডারউইনের দাদু কবি ছিলেন তা আমরা জেনেছি। কিন্তু ডারউইনের মতন কল্পনাপ্রবণ মানুষ আর সুন্দরের পূজারী, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত আর কাব্যবোধ থাকবে না তাঁর, তা কী কখনও হয় ? আসলে প্রকৃতির ওই অধরা মাধুরী সৌন্দর্য বুঝতে আর বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে, একজন বিজ্ঞানীকে হ’য়ে উঠতে হয় কবি ! তাই ডারউইন সেই অর্থে একজন সত্য সন্ধানী কবি ! নানান কাজের ঝামেলার মধ্যে এবং একমুখী চিন্তাভাবনা থেকে মুখ ফেরানোর ফুরসৎ করে উঠতে পারেন নি। পরিণত বয়সে আত্মজীবনীতে তাই তিনি লিখেছেন, ‘আবার নতুন করে জীবনটাকে শুরু করতে পারলে নিয়ম করে কবিতা পড়তেন, গান শুনতেন’ ।

কবিতার কথা দিয়েই শেষ করব এই লেখা। ২০০৯ সালে ডারউইনের জন্মের দু’শো বছর উদযাপন উপলক্ষে একটি অভিনব বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম – ‘ডারউইন – এ লাইফ ইন পোয়েম’। আদ্যন্ত কবিতার বই। লেখকের নাম রুথ প্যাডেল ! কিংস কলেজের কবিতার অধ্যাপক তিনি। প্রতিষ্ঠিত কবি এবং ঔপন্যাসিক। এই রুথ প্যাডেলের আর একটি পরিচয় হল, সম্পর্কে রুথ প্যাডেলের মায়ের দাদু – চার্লস ডারউইন ! এইভাবে কবিতার বীজ প্রবাহিত হয়ে এসেছে বংশপরম্পরায় !