মন্ত্রীমশাইয়ের বক্তব্য প’ড়ে রীতিমত গা-ছমছম ক’রে উঠছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘খগম’-এর কথা মনে পড়ছিল – রোববারের আড্ডায় আমার ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধু, কাফকার ‘মেটামরফসিস’-এর তুলনাও টানলো। সত্যি’ই তো – জঙ্গলে ঢুকে কেউ কোনোদিন দেখেছে চোখের সামনে গোটা একটা বাঁদর ধীরে-ধীরে মানুষ হয়ে যাচ্ছে ! বা বাঁদর থেকে মানুষ হওয়ার বিভিন্ন দশায় নানান্ রকমের বামানুষ বামানর ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে, গোটা জঙ্গলময় ! না – মন্ত্রীমশাই এমন’টি দেখেন নি – আমরাও অবশ্য দেখি নি – কেউ কোনোদিন দেখে নি ! আর কেউ কোনোদিন এমন’টি দেখে নি ব’লেই দেশের শিক্ষামন্ত্রীর অকাট্য প্রমাণ – ডারউইনবাদ মিথ্যা ! ডারউইনবাদ সম্বন্ধে বা বিবর্তন নিয়ে এ’রকম প্রাঞ্জল চিন্তা-ভাবনার মৌলিকত্ব আছে নিঃসন্দেহে ! ডারউইন সাহেব শিহরিত হতেন বেঁচে থাকলে। গর্বিত হতেন বিশপ উইলবারফোর্স – তাঁর দেহ রাখার ১৪৪ বছর পরেও কেউ একজন তাঁর ডারউইন-বিরোধী জিহাদ এমন সগৌরবে তুলে ধরতে প্রয়াসী হবে ! বিশপ সাহেব বিজ্ঞানের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবেন ডারউইনের বন্ধু হাক্সলি-র উদ্যেশ্যে করা তাঁর উক্তির জন্যে – “দাদু না দিদা কার সূত্রে হাক্সলি বাঁদর থেকে মানুষ হয়েছেন ব’লে দাবী করেন ?” – সোজা কথায় বললে, হাক্সলি যদি বিশ্বাস’ই করেন যে, ডারউইনীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বাঁদর থেকেই মানুষের উৎপত্তি, তাহলে তাঁর কোন পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিলেন – দাদু না দিদা ?
ডারউইন কী বলেছিলেন না-দেখে, বরং দেখা যাক ডারউইন কী বলেন নি। উনি বলেন নি, যে একদিন হঠাৎ বাঁদরগুলো সব মানুষ হয়ে গেল। ভদ্রলোক এটা’ই বলতে চেয়েছিলেন যে, সব প্রাণীর’ই এক অতীত পুরুষ আছে। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন সময়ে সেই আদি প্রজাতির থেকেই এসেছে। সেই ধারায় বিবর্তনের পথ বেয়ে তাই কোনো দু’টি প্রজাতির মধ্যে নিকট বা দূরতর আত্মীয়তা থাকবে। সেই বিবর্তনের ধারায় মানুষের আসার কিছু-আগে এসেছে বানরগোষ্ঠীর প্রাণী এবং সাযুজ্যের নিরিখে মানুষ’ও আসলে বানর গোষ্ঠীর’ই সদস্য। ডারউইন বলেন নি যে, বিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ আছে – অর্থাৎ বিবর্তনের উদ্দেশ্য’ই নয় উন্নত প্রজাতি তৈরি করা। ডারউইনের তত্ত্ব শেখায় যে, বিবর্তনের কোনো লক্ষ্য নেই। বিবর্তনের পথে সরলতর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের থেকে ক্রমে জটিলতর বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতেই পারে এবং সেই পথে’ই এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে পৃথিবীতে। সেই পথে’ই যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু প্রজাতি – সেই পথে’ই এসেছে শিম্পাঞ্জী-নিয়ান্ডারথাল মানুষ হয়ে আজকের-মানুষ। ডারউইনের তত্ত্ব এটা’ও বলে না যে, একটি নতুন প্রজাতির আবির্ভাব হওয়া মানেই আগের প্রজাতির বিলুপ্তি। যেমন একটি সময়ে – বেশীদিন নয় – এই ৫০–৭০ হাজার বছর আগেই- একইসঙ্গে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে শিম্পাঞ্জী, দেশের হনুমান, নিয়ান্ডারথাল মানুষ, জাভা মানুষ, হোমো ইরেক্টাস আর আজকের আধুনিক মানুষ – যদিও এদের সকলের’ই বিভিন্ন সময়ে উদ্ভব একটি উৎস প্রজাতি থেকেই।
চুপি-চুপি বলি, ছেলেবেলায় এই বানর থেকে মানুষ হওয়ার ব্যাপারটা যখন কানে আসে, ব্যাপারটা তখন একটু গোলমেলেই লেগেছিল। বড় হয়ে যখন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্ব একটু বুঝলুম – বুঝলুম সাধারণ বংশদ্ভূতির তত্ত্ব (ইভোলিউশন বাই কমন ডিসেন্ট) তখন বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছিল খানিক। আরও পরে বুঝলুম, ডারউইনবাদ আসলে দৃঢ় করে বিশ্বপ্রকৃতির নানা ঘটনার বস্তুবাদী বিশ্লেষণকে’ই। হাফপ্যান্ট-পরা ছেলেবেলার আমি এ-সব কথা জানতুম না – কিন্তু সে ছিল বালখিল্য অজ্ঞানতা। মন্ত্রীমশাই নাবালক নন। প্রথাগত শিক্ষায়’ও যথেষ্ট শিক্ষিত- রসায়নশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী – ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রে’ও নাকি ডক্টরেট আছে ! আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে যদি এমন প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চশিক্ষিত কেউ – সর্বোপরি, দেশের শিক্ষার নিয়ন্ত্রকের আসন থেকে – বলে বা বিশ্বাস করে, তা’হলে ধ’রে নিতে হয় – হয় মস্তিষ্কের গোলমাল, অথবা এ-পাগলামির প্যাটার্ন আছে।
প্যাটর্নের কথা’ই যদি উঠলো, তাহলে বলতেই হয় – বিশপ উইলবারফোর্সের সময় থেকে এই হাল অবধি ডারউইনের তত্ত্ব মাঝে-মাঝেই পড়েছে আক্রমণের মুখে। খ্রীস্টান ক্যাথলিক-চার্চ কোনোদিন’ই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছন্দে থাকে নি। ১৯৫০ সালে, পোপ দ্বাদশ পায়াস-এর আগে ‘বিবর্তন’ শব্দটি’ই কোনো খ্রীষ্টীয় নথিতে জায়গা পায়নি। ১৯৯৬ সালেও, পোপ বেনেডিক্ট বলছেন, বিবর্তনবাদ এক হাইপোথিসিস ছাড়া আর-কিছু নয়। বলছেন- মানুষ বিবর্তনের শুধু এক দিশাহীন অকারণ ফসল হতেই পারে না – মানুষ ঈশ্বরের চিন্তার’ই বস্তুরূপ। জেমস ম্যুর-এর লেখা ‘দি পোস্ট ডারউইনিয়ান কন্ট্রোভার্সি’ (১৯৭৯) বইতে বিস্তারিত রয়েছে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে প্রোটেস্টান্ট চিন্তার সঙ্গে ডারউইনবাদের বিরোধিতার ইতিহাস। ইসলামি ধ্যানধারণাতেও বিবর্তনবাদ’কে মেনে নেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি স্রষ্টার অস্তিত্ব’কে ডারউইনবাদ নাকচ করে ব’লেই।
কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির লাগাম যাদের হাতে, তারা কীভাবে নিয়েছে এই মতবাদকে ? উত্তর-ডারউইনীয় সময়ে কারা জড়িয়েছে ধর্মের সাথে রাষ্ট্রকে ? মাত্র গত বছর’ই তুরস্কের স্কুলে নিষিদ্ধ হয়েছে ডারউইনের মতবাদ পড়ানো। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, ইস্কুল-পড়ুয়াদের কচি-মাথায় এ’সব জটিল বিষয় নাকি ঢুকবে না। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় – যেমন নয় মন্ত্রীমশাইয়ের বক্তব্য’ও। গোটা বিংশ-শতাব্দী জুড়েই বিভিন্ন সময়ে স্কুলে-স্কুলে ডারউইনের তত্ত্ব পড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা নেমে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর’ই আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট-এর স্কুলে নিষিদ্ধ হয় ডারউইনবাদ বা বিবর্তনবাদ। ১৯২৫ সালের বিখ্যাত সেই মামলা – স্টেট অফ টেনেসি বনাম জন স্কোপ। টেনেসি’তে চালু-থাকা একটি আইন মোতাবেক বারণ ছিল সরকারী কোনো স্কুলে মানুষের বিবর্তন পড়ানো। স্কোপ মাস্টারমশাই সে আইন অগ্রাহ্য করেন – মামলা হয়। হেরে যান স্কোপ – এবং এরপরে এই মামলা’কে দেখিয়ে আমেরিকার অন্যান্য স্টেটেও নিষিদ্ধ হয় বিবর্তনবাদ পড়ানো। অবশেষে ১৯৬৮ সালে, এপারসন বনাম আরকানসাস মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় স্কুলে বিবর্তনবাদ পড়ানোর পক্ষে। ১৯৯৯ সালে, কানসাস স্কুল বোর্ডে আবার চেষ্টা হয় ডারউইনবাদ পড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারির – যা সৌভাগ্যবশতঃ নাকচ হয়ে যায়। নেদারল্যান্ডে ২০০৫ সালেও, সে দেশের শিক্ষামন্ত্রী ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ নামের একটি আদতে বিবর্তনবাদ-বিরোধী তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সওয়াল করছেন। ২০০৬-তে, পোল্যান্ডের শিক্ষামন্ত্রীর উক্তি ছিল, বিবর্তনবাদ একটি মিথ্যা এবং এর পঠনপাঠন বন্ধ হওয়া’ই উচিৎ।
আর এই তালিকায় নবতম সংযোজন আমাদের একদম নিজের ঘরের শিক্ষামন্ত্রীর ! বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না –কেন।দেশে-দেশে আধুনিক জ্ঞানের অগ্রগতির বিরুদ্ধে যারা- বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের বিরোধী যারা – ইতিহাস’কে বিকৃত করে যারা – আর সর্বোপরি ধর্মীয় চিন্তা ও দর্শন’কে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে মেলায় যারা – বিভিন্ন সময়ে তারা’ই বিরোধীতা করেছে বিবর্তনবাদের। দেশে-দেশে বিভিন্ন সময়ে ডারউইনের চিন্তার বিরোধিতা করেছে যারা – তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নিজে যে দর্শনের ধারক-বাহক তার যে দারুণ মিল !