সম্প্রতি বিজ্ঞান জগতে এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে চীনের তৈরি এক কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা। এর নাম ‘এ আই – নিউটন’। সাধারণ এ আই যেখানে তথ্য দেখে কেবল প্যাটার্ন চেনে, সেখানে এ আই – নিউটন আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংগৃহীত কাঁচাতথ্য বিশ্লেষণ করে নিজে থেকেই পদার্থবিদ্যার মূল মৌলিক সূত্র উদ্ভাবন করতে পারে। একে একপ্রকার ক্ষুদ্র ডিজিটাল বিজ্ঞানীও বলা যেতে পারে । এটি প্রচলিত এ আই মডেলগুলোর সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে বৈজ্ঞানিক ধারণা গঠনের দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ইয়ান-চিং মা জানান, এ আই – নিউটন মানুষের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধাপগুলো অনুকরণ করে জ্ঞান তৈরি করতে শেখে। প্রথমে তথ্য বিশ্লেষণ করে সরল সম্পর্ক খুঁজে বের করে, তারপর সেই ধারণাকে নতুন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আরও বিমূর্ত নীতিতে উপনীত হয়। এই দক্ষতা এ আই -কে মানুষের নির্দেশনা ছাড়াই বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের সম্ভাবনা দেয়। অর্থাৎ, মানুষের মতোই এটিও ধারণা তৈরি → ধারণা যাচাই → নতুন সূত্র আবিষ্কার —এই বৈজ্ঞানিক চক্রটি অনুসরণ করে।
এ আই-নিউটন -এর প্রধান প্রযুক্তিটি হলো সিম্বলিক রিগ্রেশন বা উপাত্ত দেখে গাণিতিক সূত্র আবিষ্কারের কৌশল। আরেকটু সহজভাবে বললে, এই মডেলটি প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল আছে কিনা, কোন সমীকরণটি সবচেয়ে ভালভাবে কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, এইসব খুঁজে বের করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেয়ন ভাফার মতে, এই পদ্ধতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বিশেষভাবে আশাব্যঞ্জক। কারণ এক্ষেত্রে কৃ বু -কে কেবল হিসাব নয়, বরং ধারণাগত যুক্তি গঠনেও উৎসাহিত করা হয়।
গবেষকেরা পদার্থবিদ্যার ৪৬টি সুনির্দিষ্ট পরীক্ষাসংক্রান্ত তথ্য সিমুলেটর দিয়ে তৈরি করে এ আই- নিউটন-এর সামনে উপস্থাপন করেন। তার মধ্যে ছিল স্প্রিংয়ের দোলন, বলের সরল গতি, বস্তুর সংঘর্ষ, তরঙ্গ-কম্পন, দোলকের মতো জটিল আন্দোলন ইত্যাদি। বাস্তবের মতো অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে সিমুলেটরে অতিরিক্ত পরিসংখ্যানগত ত্রুটিও যুক্ত করা হয়।
মডেলটিকে প্রথমে একটি বলের অবস্থান বনাম সময়ের তথ্য দেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয়, সেখান থেকে এটি নিজেই বেগের সমীকরণ তৈরি করে ফেলে। পরে সেই জ্ঞান ব্যবহার করে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে বলের ভর নির্ণয় করে। অর্থাৎ, এটি পূর্বের জ্ঞান সংরক্ষণ করে পরবর্তী সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করতে পারে। এ তো একেবারেই মানুষের যুক্তিবোধের ক্ষুদ্র অনুকরণ। যদিও এর ফলাফল এখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি, তবুও এর প্রাথমিক সাফল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এর আগে, ২০১৯ সালে ইটিএইচ জুরিখ ‘এ আই-কোপার্নিকাস’ নামক একটি মডেল তৈরি করেছিল, যা গ্রহের কক্ষপথ অনুমান করে তাদের গতির সমীকরণ তৈরি করত। তবে সেখানে মানুষের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হত। কিন্তু, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এম আই টি ও হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন—বৃহৎ ভাষা মডেলগুলো প্রাপ্ত (যেমন-জি পি টি, ক্লাউড,লামা) কক্ষপথের উপাত্ত থেকে ভবিষ্যতের অবস্থানের পূর্বাভাস দিতে পারে বটে, কিন্তু সেই উপাত্ত থেকে আকর্ষণ বলের সূত্র তৈরি করতে গেলে তারা সম্পূর্ণ অর্থহীন অযৌক্তিক সমীকরণ তৈরি করে।
এই বৈপরীত্য স্পষ্ট করে দেখায় যে এ আই- নিউটন কেবল তথ্য ব্যাখ্যা করে না, সে তথ্য থেকে নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ভাবন করতে পারে। যদিও মানব-সদৃশ পূর্ণাঙ্গ যুক্তিবোধ অর্জন করতে এখনো অনেক পথ বাকি, তবুও এটি যে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের জগতে এক নতুন বিস্ময়ের গভীর ছাপ রাখতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
সূত্র: A Chinese AI model taught itself basic physics — what discoveries could it make? By Mohana Basu, published in ‘nature’ journal,14/11/2025.
doi: https://doi.org/10.1038/d41586-025-03659-4.
