ঢেউ না কণা? নাকি ঢেউ-কণা?

ঢেউ না কণা? নাকি ঢেউ-কণা?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

আলো জিনিসটা ঢেউ না কণা? প্রশ্নটা বহু পুরোনো। বিতর্কটাও।
কাকে বলে ঢেউ আর কাকে বলে কণা? এর একটা সুন্দর সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের পদার্থবিজ্ঞানী রিকার্ডো সাপিয়েন্‌জা। তিনি বলছেন, কোনো একটা বস্তুকে যদি দেশে (স্পেসে) একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে রেখে বর্ণনা করা যায় তাহলে সেটা কণা। ঢেউকে কিন্তু দেশে (স্পেসে) একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে রেখে বর্ণনা করা যাবে না। কারণ ঢেউ চলমান, ঢেউয়ের আছে ওঠা-পড়া, আছে উচ্চতম আর নিম্নতম মাত্রার দূরত্ব। ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে’।
এবার যদি প্রশ্ন করি, আলো জিনিসটা ঢেউ না কণা, তাহলে বেশ ফাঁপরে পড়তে হয়।

সতেরো শতকে নিউটন বলেছিলেন, আলো হচ্ছে কণা। সত্যিই তো, একটা বাতির আলোর সামনে একটা অস্বচ্ছ পর্দা ধরলে আলো তাকে পেরিয়ে যেতে পারে না। কারণ আলো চলে সোজা রাস্তায়। ঢেউ হলে বেঁকে যেতে পারত। আপাতদৃষ্টিতে অকাট্য প্রমাণ।

কিন্তু আঠেরো শতকে টমাস ইয়ং অন্য একটা পরীক্ষা করে প্রমাণ করলেন, আলো আসলে ঢেউই। ইয়ং একটা বাতি জ্বালিয়ে তার সামনে একটা ধাতুর পাত রাখলেন। পাতে দুটো ফোকর কাটলেন। বাতি থেকে বেরিয়ে আলো সেই দুটো ফোকর পেরিয়ে একটা পর্দায় গিয়ে পড়ল। দেখা গেল, পর্দা জুড়ে কালো পটি আর আলোর পটির জটিল বিন্যাস ফুটে উঠেছে। এ ঘটনাটাকে পদার্থবিজ্ঞানে বলে ব্যতিচার (ইন্টারফিয়ারেন্স)। আলো যদি কণা হত, তাহলে কিন্তু এ ঘটনা ঘটত না। তাহলে আলোর দুটো আলাদা গুচ্ছ পর্দার দুই দিকে দুটো আলাদা ক্ষেত্রে গিয়ে সংহত হত।

উনিশ শতকে হাইনরিখ হার্ৎজ লক্ষ করলেন, একটা ধাতুপৃষ্ঠের ওপর অতি-বেগুণি আলো ফেললে ধাতুপৃষ্ঠটা থেকে একটা চার্জ বেরোয়। এ-কে বলা হয় আলোক-বিদ্যুৎ ক্রিয়া (ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট)। ব্যাপারটার তাৎপর্য কী তা অবশ্য তখনই বোঝা গেল না। বরং বিষয়টা উত্তরোত্তর জটিল একটা ধাঁধার মতন হয়ে উঠল। কীসের ধাঁধা?
পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনদের শক্তি-মাত্রা একেকটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বাঁধা থাকে। কাজেই তার ওপর আলো এসে পড়লে ইলেকট্রনগুলোর শক্তি তো বেড়ে যাবার কথা। আর তা যদি হয় তাহলে তারা পরমাণু থেকে আরও উজ্জ্বল আলো নিয়ে আরও জোরে ছিটকে বেরিয়ে আসবে, এটাই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু হার্ৎজ-এর পরীক্ষার ভিত্তিতে আরও যেসব পরীক্ষা চালানো হল, তা থেকে দেখা গেল মোটেই সে-ঘটনা ঘটছে না।

আইনস্টাইনের আলোক-বিদ্যুৎ ক্রিয়া সমীকরণ
বিশ শতকে এই হেঁয়ালির উত্তর দিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি প্রমাণ করলেন, পরমাণুরা আলোর ঢেউ থেকে এক নাগাড়ে শক্তি শোষণ করে না। তারা আলো থেকে একেক বারে একেকটা করে আলোক-শক্তির পুঁটুলি টেনে নেয়। আলোক-শক্তির সেই পুঁটুলির নাম আলো-কণা (ফোটন)। অর্থাৎ আবার ফিরে এল আলোর সেই কণা-তত্ত্ব।
তাহলে কী দাঁড়াল? আলো জিনিসটা কণা না ঢেউ? সাপিয়েনজা বলছেন, এই প্রশ্নটাই আসলে ঠিক নয়। কারণ আলো সব সময়েই ঢেউ আর কণা দুই রূপেই বিরাজ করে। আমরা কী ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছি তার ওপর নির্ভর করে কখনো সেটা ঢেউ রূপে, কখনো বা কণা রূপে প্রতিভাত হয়। আজকাল অত্যাধুনিক এমন সব পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে যাদের চরিত্র ঠিক আলোরই মতো। তাদের দিয়ে অনেক অদ্ভুত কাজ করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে, যা আগে সম্ভব হত না। সেখানে আলোর এই দ্বৈত চরিত্রটাই আমাদের কাজে লাগছে।
সাপিয়েনজা একটা চমকপ্রদ বিষয়ের উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করেছেন। “ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান অনুযায়ী ইলেকট্রনগুলো একেকটা সুনির্দিষ্ট দশায় না-থাকলে পরমাণুগুলো সুস্থিত অবস্থায় থাকতে পারত না। এর কণা-চরিত্রটা যদি অস্বীকার করি, তাহলে একথাও অস্বীকার করতে হয় যে ওর একটা নির্দিষ্ট শক্তিমাত্রা আছে – সেক্ষেত্রে প্রাণের অস্তিত্বই থাকে না”।
সুতরাং “আলো কণা, নাকি তরঙ্গ?” – এ প্রশ্নের উত্তর হল, আলো একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। আলোর এই দ্বৈত চরিত্র আমাদের প্রাণেরও রহস্য।
সূত্র: https://www.livescience.com/physics-mathematics/particle-physics/is-light-a-particle-or-a-wave